বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ওলটপালট অর্থনীতি

  •    
  • ২১ এপ্রিল, ২০২১ ২০:২৫

করোনাভাইরাস সংক্রমণের চলমান ধারা দীর্ঘায়িত হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের গতি নিম্নমুখী হবে। একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ। অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোতেও নেতিবাচক ধারা নেমে আসবে। 

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় আবার মুখ থুবড়ে পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অনুমানের চেয়েও অনেক নেমে যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকেরও উদ্বেগের শেষ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের চলমান ধারা দীর্ঘায়িত হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের গতি নিম্নমুখী হবে। একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ। অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোতেও নেতিবাচক ধারা নেমে আসবে। আর এতে একদিকে যেমন করোনার প্রথম ঢেউয়ের প্রভাবে অর্থনীতিতে পড়া নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে ওঠার কার্যক্রমে ভাটা পড়বে, তেমনি নতুন সংকট যোগ হয়ে সবকিছুকে তছনছ করে দেবে।

দেশের সার্বিক হালনাগাদ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব শঙ্কার কথা বলা হয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, দ্বিতীয় ঢেউ দীর্ঘস্থায়ী হলে অর্থনীতির যে খারাপ অবস্থা হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতে মানুষের আয় কমবে; কমবে ব্যয় করার সক্ষমতা। সবকিছু স্থবির থাকায় স্বাভাবিকভাবেই চাহিদা ও উৎপাদন কমবে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় খুব বেশি কিছু করার আছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, ভাইরাসের নিয়ন্ত্রণ কারও কাছে নেই। তবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে টিকায় বেশি জোর দিতে হবে।’

আরেক অর্থনীতিবিদ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘করোনার প্রথম ঢেউয়ের কারণে অর্থনীতি খাদে পড়েছিল। সেখান থেকে আমরা প্রায় উঠে আসছিলাম। এর মধ্যে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এতে অর্থনীতি আরও খাদে পড়েছে। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখ, রমজান এবং ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে যে লেনদেন হতো, তাতে বিপর্যয় নেমে এলো।

‘এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি ৪-৫ শতাংশও হয়, সেটাও আমাদের জন্য বড় অর্জন হবে বলে আমি মনে করি।’

আহসান মনসুর বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার কঠোর লকডাউন দিয়েছে। নিশ্চয়ই ভেতরে একটি পরিকল্পনা রয়েছে। তা সবাইকে জানানো হয়নি। তবে ওই পরিকল্পনা অবশ্যই স্মার্ট, বাস্তবসম্মত এবং বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় ঢেউয়ের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নতুন প্রণোদনা দিতে শুরু করেছে সরকার। আমি এখানে পরিষ্কার করে একটি কথা বলতে চাই, প্রথম দফায় সোয়া লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন কিন্তু সন্তোষজনক নয়।

‘এখন পর্যন্ত মোট প্রণোদনার অর্ধেকের মতো বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র। বড় বড় উদ্যোক্তারা প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পেলেও ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা তেমন পায়নি। নতুন প্রণোদনার ক্ষেত্রে যেনো তেমন না হয়, সেটা খুব ভালো করে বিবেচনায় রাখতে হবে।’

‘অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব’ শীর্ষক গত ৩১ মার্চ প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের স্বার্থে চলমান নীতিসহায়তাগুলো অব্যাহত রাখা ও প্রণোদনা বাস্তবায়নে তদারকি আরও জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মূল্যের স্থিতিশীলতা ধরে রাখার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কায় গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে অর্থনীতির সূচকগুলোর অবস্থা বেশ তলানিতে পড়ে যায়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকেও তা অব্যাহত থাকে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে তা আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।

করোনার আগে গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চে শিল্প উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশ। এপ্রিল থেকে তা কমতে থাকে। এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে তা কমে নেতিবাচক পর্যায়ে ২০ শতাংশে নেমে যায়। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে তা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তবে গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে তা আবার বেড়ে ৮ শতাংশে দাঁড়ায়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে এই হারে আবার নিম্নগতি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গত অর্থবছরের জানুয়ারি থেকে মার্চে বাণিজ্য খাতের ঋণ বেড়েছিল ১৩ শতাংশ। গত এপ্রিল থেকে জুনে তা কমে ৬ শতাংশে নেমে যায়। পরে তা বেড়ে আগের অবস্থানে উঠে আসে। এখন আবার কমতে শুরু করেছে।

প্রতিবেদনে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে চাহিদা কমায় গত এপ্রিল ও মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার কমে গিয়েছিল। সেপ্টেম্বর থেকে চাহিদা কিছুটা বেড়েছিল। ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ফীতি আবারও বাড়তে শুরু করে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, গত মার্চ মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ।

জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ০২ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।

সাত বছর পর ২০২০ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ঘর অতিক্রম করে ৬ দশমিক ০২ শতাংশে ওঠে। নভেম্বরে অবশ্য সামান্য কমে তা ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশে নেমে আসে।

পরের দুই মাস ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতেও এই সূচক নিম্নমুখী ছিল। ফেব্রুয়ারি থেকে তা আবারো ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার প্রথম ঢেউয়ে বেসরকারি খাতে কর্মীদের বেতন সেবাখাতে সবচেয়ে কমেছে। গত আগস্ট পর্যন্ত কমে তা আবার বাড়তে শুরু করেছিল। নতুন করে তা কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

করোনার প্রথম ঢেউয়ের প্রভাবে আমদানি কমায় বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ কমে আসছিল। গত সেপ্টেম্বর থেকে আমদানি বাড়তে থাকে। ফলে এখন আবার বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার ১৭৯ কোটি ৫০ লাখ (১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন) ডলারে উঠেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ১০ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার।

তবে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক ঋণের অর্থ ছাড় হওয়ায় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয় বেড়েছে। আমদানি কমায় কমেছে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়। এতে চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতির পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারিতে ঘাটতি ছিল ২১১ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫৬ কোটি ডলার। শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি যেমন কমেছে, তেমনি এলসি খোলার হারও কমেছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, এই অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে মোট ২ হাজার ৮৯৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২ হাজার ৮৯৭ কোটি ৩৮ লাখ ডলার।

সর্বশেষ মার্চ মাসে ৩০৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই অংক গত বছরের মার্চের চেয়ে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।

এই তথ্য বলছে, মহামারির মধ্যেও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

মহামারিকালে বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) তারা ১৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের একই চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি।

এই নয় মাসে বিদেশি ঋণ সহয়তা বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো।

শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী শিল্পপণ্য আমদানির পরিমাণ কমলেও সাম্প্রতিক সময়ে এলসি খোলার প্রবণতা বেড়েছে। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারিতে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে ২ শতাংশ।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব দীর্ঘায়িত হলে এ খাতের ঊর্ধ্বগতি নিম্নমুখী হতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

‘আর এতে বিনিয়োগে কমবে’ মন্তব্য করে আহসান মনসুর বলেন, ‘কোভিডের আগে থেকেই আমাদের বিনিয়োগের অবস্থা ভালো না। দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগ জিডিপির ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। গত অর্থবছরে এডিপি (সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি) বাস্তবায়ন বেশ কম ছিল। চলতি অর্থবছরের নয় মাসের যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে অবস্থা আরও খারাপ। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ৮ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘সবকিছু মিলিয়ে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়. বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের মুখ পড়ছে।’

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। অর্জিত হয় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

মহামারির মধ্যে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ৮ দশমিক ২ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কঠিন এই পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই এই লক্ষ্য অর্জিত হবে না।

গত ১২ এপ্রিল প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এবার ২ দশমিক ৬ থেকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।

৩০ জুন শেষ হবে ২০২০-২১ অর্থবছর। এরই মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। মহামারির মধ্যে আরেকটি বাজেট তৈরি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

প্রথা অনুযায়ী আগামী জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী।

এ বিভাগের আরো খবর