আদাবরের মনসুরাবাদ এলাকায় থাকেন রিকশাচালক মোস্তফা। যখন পাস ছাড়া বাইরে যেতে মানা, তখন দুপরে তার সঙ্গে দেখা রাজধানীর শ্যামলী এলাকায়।
জানালেন, সকাল থেকে রিকশা নিয়ে বের হয়ে রোজগার করেছেন মাত্র ৩০ টাকা। অন্য স্বাভাবিক দিনে এই একবেলায় প্রায় তিনশ টাকার রোজগার করে ফেলেন তিনি।
করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বুধবার থেকে চলা কঠোর বিধিনিষেধে মানুষের বাইরে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। এতে প্রায় রোজগারহীন হয়ে পরেছেন মোস্তফার মতো শ্রমজীবীরা। লকডাউনের প্রথম দিন যাদের ইচ্ছা না থাকলেও রাস্তায় নামতে হয়েছে। কিন্তু কাজ না পাওয়ায় তারা এখন দিশাহীন।
মোস্তফা জানালেন, তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণায়। সেখানে থাকেন তিন ছেলে ও স্ত্রী। তাদের জন্য প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে হয়।
এই পরিস্থিতিতে খাবারের টাকা ও সংসারের খরচ নিয়ে বেশ চিন্তার মধ্যে পড়েছেন। বললেন, ‘এই লকডাউন গরিব মারার লকডাউন।’
মিরপুরের পীরের বাগ ওলি মার্কেটে থাকেন রিকশাচালক মোহাম্মদ শহীদ। বুধবার দুপুরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে ভাড়া নিয়ে শ্যামলী এসেছেন। কিন্তু পুলিশের বাধায় আর বেশি দূর এগুতে পারেননি। জানালেন, শ্যামলী এলাকায় এলে তার রিকশা উল্টিয়ে এক ঘণ্টা শাস্তি দিয়েছে পুলিশ।
বললেন, ‘পুলিশ রাস্তায় যেতে দিতে চায় না। কিন্তু আমাদের তো পেটে ক্ষুধা, তাই তো রাস্তায় নামছি।’
রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় বের হওয়ায় রিকশা উল্টে রাখে পুলিশ
আরেক রিকশাচালক হান্নান। জানালেন, মঙ্গলবারও প্রায় সাতশ টাকা রোজগার করেছেন। কিন্তু মানুষ ঘরে থাকায় তেমন একটা যাত্রী নেই। এ জন্য তার মতো মানুষকরা বিপাকে।
তিনি বলেন, ‘লকডাউনে গরিব মানুষেরই বেশি কষ্ট হয়। অনেকের ভয়াবহ অবস্থা হবে। যেমন আমার পাঁচ মাইয়া, আমি যদি বাড়িতে কামাই করে না যাইতে পারি তাইলে তো পেট চলব না।’
তিনি বলেন, ‘মহাজনরে (রিক্সার মালিক) প্রতিদিন দেওয়া লাগে একশ টাকা। কিন্তু করোনার কারণে এখন আর আগের মত আয় রোজগার হয় না। আগে (করোনার আগে) এক বেলা কাজ করলে ৬-৭ টাকা কামানো যাইত। আর এক কামাই করে এক বেলা ঘুমাইতাম। এখনও দুই বেলায় ওই টাকা হয় না।’
বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় রাস্তায় এভাবে ব্যারিকেড বসায় পুলিশ। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস
সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা শামসুল আলম তার কথা শুছিলেন। তিনিও বললেন, ‘আসলেই তাদের রোজগার গত এক বছরে অনেক কমে গেছে।
‘গত এক-দেড বছরে অনেক শ্রমজীবী মানুষের জীবনধারণ অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছে। লকডাউনে তো তা আরও দূর্বিসহ।’
শ্যামলী এলাকায় দিনমজুরের কাজ করেন মোহাম্মদ মান্নান। কাজের খোঁজে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলা থেকে ঢাকায় এসেছেন। প্রতিদিন যা রোজগার করেন তা দিয়েই পেট চলে তার। লকডাউনে বেশ চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন তিনি। বললেন, ‘ঢাকাত আসছিলাম কাজের খোঁজত। এখন কাজও নাই, খাওয়াও নাই।’
রাজধানীর লালবাগ এলাকায় মহল্লায় যানবাহন ঠেকাতে মহল্লাবাসী এভাবে ব্যারিকেড বসায়
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাসা-বাড়িতে কাজ করেন সুমী আক্তার। বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুরে। করোনার কারণে বেশ বিপাকে পরেছেন তিনিও। জীবন চালাতে বেশ বিপাকে পরতে হয়েছে তাকেও। বললেন, ‘করোনার আগে যেমন বাসা-বাড়িতে কাজ পাইতাম, এখন তেমন আর কেউ বাসায় ঢুকতে দিতে চায় না, ভয় পায়। আর লকডাউনে অনেকের ছুটি হওয়ায় অনেকেই এখন ছুটি দিয়ে দিছে। লকডাউনে অনেকেই কাজে ডাকে না।’
তার প্রশ্ন ‘আমরা তাইলে কেমনে চলুম?’
তেমনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে থাকেন ফল ব্যবসায়ী মকবুল হোসেন। বিক্রি করেন ভ্যানে করে। জানালেন, অন্য স্বাভাবিক দিনে প্রতিদিন প্রায় ৫-৬ হাজার টাকার ফল বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু লকডাউনের প্রথম দিনে বুধবার অর্ধেক বেলায় বিক্রি করেছেন এক হাজার টাকার টাকার ফল। মানুষ খুব একটা না থাকার কারণে কেউ ফল নিতেও আসছে না। আর পুলিশের বাধায় রাস্তার মোড়ে ফল বিক্রি করতেও পরছেন না তিনি।
চাকরিজীবী একজনের পরিচয়পত্র দেখানোর পর তার কাছ থেকে মুভমেন্ট পাস দেখতে চাইছেন পুলিশ কর্মকর্তা। ছবিটি মিরপুর-১ এর
করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে যে লকডাউন তাতে অসংখ্য মানুষের জীবিকা পড়বে সংকটে পরে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরাও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬-১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৮ লাখ। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে (শ্রম আইনের সুবিধা পান এমন) কর্মরত জনশক্তি মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর সবচেয়ে বড় অংশ ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত।
এসব শ্রমিকের হিসাব করলে দেখা যায়, ৫ কোটির বেশি মানুষ দিনমজুরের কাজ করেন। যাদের শ্রম আইন-২০০৬ প্রদত্ত নিয়োগপত্র, কর্মঘণ্টা, ঝুঁকিভাতা, চিকিৎসাভাতা, বাড়িভাড়াসহ বেশির ভাগ অধিকারই নিশ্চিত নয়। দৈনিক কাজের ভিত্তিতে তারা মজুরি পান।