চীনকে শায়েস্তা করতে করোনা ভাইরাসকে ‘আল্লাহর সৈনিক’ উল্লেখ করে ভাইরাস প্রতিরোধে ‘ওয়ান ডট কিউ সেভেন প্লাস সিক্স ইকোয়েলটু সিক্সটিন’ ফর্মুলা দেয়া আলোচিত ইসলামি বক্তা মুফতি কাজী ইব্রাহীম এবার নতুন ‘তত্ত্ব’ নিয়ে হাজির হয়েছেন।
২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনে করোনা সংক্রমণ দেখা দেয়ার পর মুফতি ইব্রাহীমের একের পর এক উদ্ভট বক্তব্য হাস্যরস তৈরি করেছিল সামাজিক মাধ্যমে।
এবার করোনা গত বছরের চেয়ে বেশি হারে ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে এই ইসলামি বক্তা বলছেন, জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন আগের মতো ইসলামি জলসা হতে পারে না, তাই করোনার প্রকোপ বেড়ে গিয়েছে।
যদিও বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের একজন শীর্ষ আলেম বলেছেন, এগুলো আন্দাজি কথা। এর সঙ্গে কোরআন-হাদিসের কোনো সম্পর্ক নেই।
করোনা সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের মার্চের পর থেকে গণজমায়েতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। গত শীতের মৌসুমে দেশের নানা প্রান্তে ধর্মীয় আলোচনার আয়োজনেও নানা বিধিনিষেধ ছিল স্বাস্থ্যবিধির কারণে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে গত ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ আরও কড়াকড়ি করা হয়েছে। ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য এই কড়াকড়ি আরও বাড়ানো হয়েছে। এবার সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের যানবাহন বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ এসেছে। বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্য পুলিশের পাস নেয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বাজার খোলা থাকবে কেবল ছয় ঘণ্টার জন্য। দোকানপাটও খোলা থাকবে সীমিত সময়ের জন্য।
এর মধ্যে মুফতি ইব্রাহীমের একটি ওয়াজের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেই মাহফিলটা কবে কোথায় হয়েছিল, সেই তথ্য পাওয়া না গেলেও ভিডিওতে স্পষ্ট তিনি কী বলেছেন।
ওই মাহফিলে ইব্রাহীম বলেন, ‘এ বছর করোনা বাংলাদেশে একটু বেশি বেশি শুনতে পাচ্ছি। আমার কাছে বিভিন্ন কারণের পাশাপাশি এই কারণটাও মনে আসতেছে। গত বছর করোনারা বলছিল, এদেশে এত মাহফিল হয়, আল্লাহ রসুলকে নিয়ে এত আলোচনা হয়। এ জন্য করোনাদের এ দেশে আক্রমণের বেশি ইচ্ছা নাই। বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ এত মাহফিল সেখানে হয়, পৃথিবীর অন্য দেশে কিন্তু এত মাহফিল নাই। একমাত্র বাংলাদেশে আছে, হতে পারে এ কারণেই বাংলাদেশ অনেক ভালো আছে।
‘কিন্তু এবার অনেক মাহফিল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে মাহফিলের কারণে করোনারা কম আসছে, সেই মাহফিল যদি তোমরা কমায় দাও, তাহলে তো সমস্যা আছে। করোনারা বলবে, যে কারণে আমরা আক্রমণটা কমিয়েছিলাম, তোমরা তো সেই কারণটা এবার আর রাখনি। ব্যাপক মাহফিল করতা, আমরা আরও বেশি তোমাদের ছাড় দিতাম। করোনা থেকে বাঁচতে হলে বেশি বেশি মাহফিল করতে হবে।’
ইব্রাহীম গত বছর যা যা বলেছিলেন
ইসলামি বক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্ভট বক্তব্য দিয়ে বারবার আলোচনায় আসেন মুফতি ইব্রাহীম।
তিনি শুরুতে বলেন, করোনা মুসলমানদের জন্য আসেনি। চীনে এক মুসলিম তরুণীকে সে দেশের তিনজন সৈনিক ধর্ষণ করেন, তাদের শায়েস্তা করতে আল্লাহ করোনা পাঠান। সারা বিশ্বের অমুসলিমদের শায়েস্তা করা হবে এই ভাইরাস দিয়ে। সব মিলিয়ে ২০০ কোটি মানুষকে এই ভাইরাস মেরে ফেলবে।
ইতালিপ্রবাসী জনৈক মামুন মারুফের বরাত দিয়ে করোনার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ধারাবাহিক বয়ানও করে গেছেন মুফতি ইব্রাহীম। করোনা কেন এসেছে, কাদের কাদের এটি ‘শায়েস্তা করবে’ এমন বর্ণনার পাশাপাশি মুফতি ইব্রাহীম দাবি করেছেন, করোনা সে সময় বাংলাদেশ নিয়ে তার পরিকল্পনাও তুলে ধরে।
করোনাভাইরাস নাকি বলেছিল, বাংলাদেশে কোরআনের যত আলোচনা হয়, এত আলোচনা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে হয় না। তাই বাংলাদেশে করোনার আঘাত হানার কোনো পরিকল্পনা নেই।
‘তবে কিছু ইসলামবিরোধী মুনাফিকদের শেষ করে দেবো;-করোনাভাইরাসের এই পরিকল্পনা সে সময় জেনেছেন মুফতি ইব্রাহীম।
তিনি বলেন, যুগে যুগে আল্লাহ মহামরি দিয়েছেন ইমান আনার জন্য, মানুষকে ইসলামমুখী করার জন্য। কোনো মহামারি চিকিৎসা দিয়ে পার পাওয়া যাবে না।
সে সময় করোনা প্রতিরোধে যে ‘ফর্মুলা’ মুফতি ইব্রাহীম দিয়েছিলেন, সেটি হলো, ‘ওয়ান ডট কিউ সেভেন প্লাস সিক্স ইকোয়েলটু সিক্সটিন’।
এই ফর্মুলা দেয়ার দিন এর ব্যাখ্যা না দিয়ে মুফতি ইব্রাহীমের বক্তব্য নিয়ে পরে বহু ট্রল হয়। তিনি সেদিন বলেন, ‘জানি, কিন্তু বলব না।’
পরে আরও নানা আলোচনা-সমালোচনার পর ইব্রাহীম এই ‘সূত্রের’ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ওয়ান মানে এক আল্লাহর প্রতি ইমান লাগবে। কিউ মানে কোরআন সেভেন মানে কোরআনের সাত আয়াত বিশিষ্ট সুরা ফাহেতা। এটা সকল রোগের চিকিৎসা।
আর সিক্স মানে ত্বীন বা ডুমুর ফল, যাইতুন বা জলপাই, কালোজিরা, আজওয়া খেঁজুর, মধু আর জমজমের পানি। এই ছয়টিই শেফা বা রোগমুক্তির উপায়।
তবে ভাইরাস জানিয়েছে, এগুলো থেকে কত ডিগ্রি সেলসিয়াসে নির্যাস বের করতে হবে। এটার তাপমাত্রা আলাদা। সাতজন হাফেজ দ্বারা জমজমের পানি দিয়ে লিখে কীভাবে বানাতে হবে, তার ফর্মুলা হবে।
তবে সেই ফর্মুলা না দিয়ে তিনি বলেন, ‘ওইটা আমি দিচ্ছি না। আমি ১৩টা দিলাম, তোমরা বিজ্ঞানীরা বানিয়ে দেখাও।’
কালোজিরা ২১টি দানা সন্ধ্যায় ভিজিয়ে সকালে পানিটা নিয়ে নাকের ডান দিকে দুই, বামে এক, আবার বামে দুই ডানে এক, আবার ডানে দুই বামে এক-এভাবে নয় ফোঁটা দিতে হবে। এটা সকল রোগের চিকিৎসা। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এত বাড়াবে যে সব ভাইরাস মারা যাবে।
এই স্বপ্ন নিয়ে ট্রল শুরু হয়ে গেলেও মুফতি ইব্রাহীম এক ওয়াজে বলেন, ‘আমি শুনেছি করোনাভাইরাস নিয়ে আমার স্বপ্নটা এমেরিকায় ব্যাফক ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হয়ে বিজ্ঞানীরা সব এটা নিয়া স্টাডি শুরু করেছে যে, কইল কি, হুজুরে হয় কী? হুজুরের কথায় সার আছে। এটা স্বপ্ন হিসেবে সত্য, স্বপ্ন বাদ দাও, স্বপ্ন যদি বিশ্বাস না করো বাদ দাও, যে ১৩টা আইটেম, ১৩টাই শেফা।’
বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক যা বলছেন
মুফতি ইব্রাহীমের এসব বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে কওমিপন্থিদের মধ্যে ব্যাপক গুরুত্ব পাওয়া বসুন্ধরার ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এগুলো আন্দাজি কথা। পবিত্র কোরআন-হাদিসে এমন কোনো কথা নেই যে মাহফিল কম হলে করোনা বেশি হবে, মাহফিল বেশি হলে করোনা কম হবে। এর সঙ্গে পবিত্র কোরআন-হাদিসের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা তার ব্যক্তিগত মত।’
করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে আক্রান্ত হয়েছে অনেক মুসলিম দেশ। সৌদি আরব ও ইরান এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে।
করোনা সংক্রমণের প্রেক্ষিতে সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, টিকা না নিলে ওমরাহ পালন করা যাবে না।
রজমান মাসে ইসলামের দুই পবিত্র মসজিদ মক্কা ও মদিনায় এবার ইফতার মাহফিল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে যেতে পারবে না শিশুরা। মুসল্লিদের সংখ্যাও সীমিত করা হয়েছে।
কওমি আলেমদের আরও যেসব বক্তব্যে হাস্যরস
করোনাভাইরাসের প্রকোপের পর কেবল মুফতি ইব্রাহীম নন, মাওলানা তারিক মনোয়ার, হাল আমলের ক্রেজ মিজানুর রহমান আজহারী, আমির হামজাসহ কওমি আলেমরা সে সময় বারবার বলে এসেছেন, করোনা আল্লাহর সৈনিক। এটি এসেছে অমুসলিমদের শায়েস্তা করতে, ঠিক মতো নামাজ পড়লে বা রোজা রাখলে করোনা হবে না। এমনকি মাস্ক পরতেও তারা মানুষকে নিরুৎসাহিত করে আসছিলেন।
আজহারি বলেছিলেন, আল্লাহ তার করোনা সৈনিককে পাঠিয়েছেন অবিশ্বাসীদের শায়েস্তা করতে।
তারেক মনোয়ার মাস্ক না কিনে ১০ টাকা দিয়ে টুপি পরে মসজিদে যাওয়া আর সুরা পড়ে বাড়ির বাইরে যাওয়ার টোটকা দিয়েছিলেন।
আমির হামজা বলেছিলেন, কেউ যদি পাঁচ ওয়াক্ত সঠিকভাবে নামাজ পড়ে, তাহলে কারও করোনা হবে না। হলে পবিত্র কোরআন শরিফ মিথ্যা হয়ে যাবে।
তিনি এমনও বলেন, করোনা হওয়ার কারণে চীনে দলে দলে মানুষ মুসলমান হয়ে যাচ্ছে। এক বছর পরে সেখানে মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের মানুষ খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
কওমিপন্থিদের মধ্যে মুরুব্বি হিসেবে পরিচিত এক আলেম বলেছিলেন, চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং করোনা প্রতিরোধে বেইজিং এর মসজিদের খতিবের কাছে গিয়ে ধরনা দিয়েছেন।