বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বঙ্গবন্ধুর সেই ভাস্কর্য ধোলাইপাড়ে নয়, ‘অন্য জায়গায়’

  •    
  • ১১ এপ্রিল, ২০২১ ২০:২৩

প্রকল্পটির পরিচালক জানিয়েছেন, ভাস্কর্যটি অন্যত্রে স্থাপন করা হতে পারে। এছাড়া ভাস্কর্যের ডিজাইন বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে অনুমোদন হয়ে আসেনি। যে কারণে আপাতত ধোলাইপাড়ে ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।

হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধোলাইপাড় মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ। সড়িয়ে ফেলা হয়েছে নির্মাণ সামগ্রী। এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অংশ হিসেবে ভাস্কর্যটি নির্মাণ ও স্থাপনের কাজ চলছিল।

প্রকল্পটির পরিচালক জানিয়েছেন, ভাস্কর্যটি অন্যত্রে স্থাপন করা হতে পারে। এছাড়া ভাস্কর্যের ডিজাইন বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে অনুমোদন হয়ে আসেনি। যে কারণে আপাতত ধোলাইপাড়ে ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।

ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারী ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের একজন নেতা দাবি করেছেন, তাদেরকে জানানো হয়েছে ভাস্কর্যটি আর সেখানে বসছে না। তবে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য এখনও আসেনি।

হেফাজত যখন ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করে মাঠে নামে, সে সময় এখানে ভাস্কর্য হবেই ঘোষণা দেয়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলছেন, সেখান ভাস্কর্য হবে না, এই বিষয়টি তার জানা নেই।

সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী এই খবর জেনে আশাহত হয়েছেন। তিনি একে দেখছেন ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে নৈতিক পরাজয় হিসেবে। বলেছেন, এর পরিণতি কখনও ভালো হবে না।

গত ২ এপ্রিল রাতে ধোলাইপাড় মোড়ে টিন ও ত্রিপল দিয়ে বানানো বেষ্টনীর ত্রিপলের অংশটুকু খুলে ফেলা হয়। ভেতর থেকে নির্মাণ সামগ্রীও সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে কেন তা সরানো হয়েছে তা জানে না ধোলাইপাড় মোড় সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা।

ধোলাইপাড় মোড়ে ডাব বিক্রি করেন রাজ্জাক মিয়া। তিনি বলেন, ‘বাতাসে উপরে একদিকের ত্রিপাল ছিইড়া গেছিল। রাতে ওদের (প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা) লোকজন এসে সবডাই খুলে নিছে। পরে শুনলাম ভেতরের জিনিসপত্র নাকি নিয়ে গেছে।’

চীনে তৈরি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বসানোর জন্য নির্ধারিত স্থান ধোলাইপাড় মোড় থেকে নির্মাণ সামগ্রী সড়িয়ে নেয়ার প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক সবুজ উদ্দিন খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনুমতি পেলে আবার কাজ শুরু হবে।’

ভাস্কর্যের ডিজাইন অনুমোদনের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমোদন লাগবে। ধোলাইপাড়ে ভাস্কর্যটি স্থাপনের জন্য ভিত্তি নির্মাণ শেষ হয়েছে। ভাস্কর্য স্থাপনের অন্যান্য কাজও হাফডান হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে আবার কাজ শুরু হবে।

গত নভেম্বরে এই ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে দেশে নানা ঘটনা ঘটে। কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধর্মভিত্তিক দলগুলো ভাস্কর্যকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে মাঠে নামে।

এই দলগুলোর বক্তব্য ছিল আক্রমণাত্মক। প্রথমে মাঠে নামে চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির ফয়জুল করীম। পরে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক হুমকি দেন, ভাস্কর্য নির্মাণ হলে তিনি আরেকটি শাপলা চত্বর পরিস্থিতি তৈরি করবেন।

সব শেষে হেফাজতের আমির জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, ভাস্কর্য নির্মাণ হলে তারা টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেবেন।

এর মধ্যে ৪ নভেম্বর প্রথম প্রহরে কুষ্টিয়া শহরে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন একটি ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়। এরপর স্থানীয় একটি মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়।

শুরুতে চুপ থাকলেও পরে সরকার সমর্থকরা মাঠে নামে। মৌলবাদী গোষ্ঠীকে প্রতিহতের ঘোষণা দেয়া হয়। ফয়জুল, বাবুনগরী, মামুনুলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। সেই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন এখনও জমা পড়েনি।

রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি প্রশাসনের কর্মকর্তারও সারাদেশে একযোগে সমাবেশ করে ভাস্কর্যবিরোধীদেরকে সতর্ক করে দেয়। জাতির পিতার সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার শপথও নেয়া হয় সেখানে।

বঙ্গবন্ধুর সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার প্রত্যয়ে ফরিদপুরে প্রশাসন, পুলিশসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মিছিল। সাম্প্রতিক ছবি

এর মধ্যে ১২ ডিসেম্বর এক অনলাইন আয়োজনে এসে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় হেফাজতকে মোকাবিলার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘আজ তারা সাহস করেছে জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙার। এটা কী? এটা আমাদের স্বাধীনতার চেতনায় হামলা। যারা এদেশের চেতনার বিরুদ্ধে, তারাই এ হামলা করেছে।’

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। ফাইল ছবি

এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য হবেই, আরও একটা হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

তবে ১৫ ডিসেম্বর কওমিপন্থিদের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এরপর থেকে দুই পক্ষ একেবারেই নীরব।

এই বৈঠকের পর কওমিপন্থিদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সিদ্ধান্ত জানাবেন মন্ত্রী। আর মন্ত্রী জানান, ভাস্কর্য ইস্যুতে আর রাস্তায় না নামতে সরকারের সঙ্গে আলেমদের ঐকমত্য হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান হবে।’

পরে আলোচনার বিস্তারিত আর সরকার প্রকাশ করেনি। এর মধ্যে ভাস্কর্য বিতর্কও স্থিমিত হয়ে আসে।

ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ও সড়ক ও জনপথ বিভাগের এই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান বলেন, ‘অন্যত্র স্থাপনের একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে চূড়ান্তভাবে এখনই বলা যাচ্ছে না।’

ভাস্কর্য ইস্যুতে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সম্প্রতি আমাদের একটা আলোচনা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ধোলাইপাড়ে ভাস্কর্য স্থাপন করা হবে না।’

কী বলছে আওয়ামী লীগ ও সমমনারা

কী কারণে ধোলাইপাড়ের নির্মাণাধীন ভাস্কর্যটির কাজ আটকে আছে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনো কারণে আটকে থাকার কথা আমি শুনি নাই। তবে আমি অ্যাকুরেটলি বলেতে পারব না।’

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বিচারপিত এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ‘ভাস্কর্য নির্মাণের কাজটি যদি বন্ধ হয়ে যায়, এটা হবে আমাদের জন্য আত্মঘাতী, সত্যি সত্যি আত্মঘাতী।’

তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে ওদের (হেফাজতে ইসলাম) সঙ্গে আপোস করে যে মারাত্মক ভুলটা করেছি তার খেসারত দিচ্ছি আজ। এখনও যদি তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর না হই, এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকবে না, এদেশটি তালেবান দেশ হয়ে যাবে, পাকিস্তান হয়ে যাবে।’

লন্ডনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য

ভাস্কর্য সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া মানে পরাজয় বলেও মনে করেন এই বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা মুক্তিযুদ্ধের শক্তি কি পরাজয় বরণ করব ওদের কাছে? যদি পরাজয় বরণ করি আমাদের পরাজিত থাকতে হবে। সেটি তখন তালেবানি রাষ্ট্র হয়ে যাবে, আওয়ামী লীগের সরকার আর মুক্তিযুদ্ধের সরকার থাকবে না।’

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নির্ধারিত জায়গা থেকে সরকার ভাস্কর্যটি সরিয়ে নিচ্ছে কি নিচ্ছে না, বিষয়টি আমার জানা নেই। কোনো কিছু না জেনে মন্তব্য করা ঠিক নয়।’

কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দল ও হেফাজতের আপত্তিতে এর আগেও ভাস্কর্য স্থাপন বন্ধ বা স্থানান্তর হয়েছে।

২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ ও শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়ার দিন ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দফা দিয়েছিল, তার একটি ছিল সব ভাস্কর্য ভেঙে ফেলতে হবে।

পরে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে জাস্টিস লেডির ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়া হয় হেফাজতের আন্দোলনের কারণে।

এর আগে ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকায় বিমানবন্দর মোড়ে লালনের ভাস্কর্য নির্মাণ প্রকল্প বাদ দেয়া হয় কওমিপন্থিদের আন্দোলন ও হুমকির মুখে।

তবে ধর্মভিত্তিক দলগুলো এবারের আগে কখনও বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেনি।

গত বছরের নভেম্বরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে কওমিপন্থিরা মাঠে নামার পর আওয়ামী লীগের শরিক জাসদ এক বিবৃতিতে বলে, সরকারের আশকারাই এর কারণ।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য স্থানান্তরিত করার মধ্য দিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ীদের আশকারা দেওয়ার ফলেই আজ এই অপশক্তি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখাতে পারছে।’

এ বিভাগের আরো খবর