শুক্রবার সকালে ঢাকা আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা জন কেরি, যিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। জন কেরি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জলবায়ু উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন নিউজবাংলাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন প্রশাসনের অন্যতম প্রধান ইস্যু জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা করে করোনাকালে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন নতুন খাত উদ্ভাবন। আগামী দিনের এই জলবায়ু লড়াইয়ে জয়ী হতে বাংলাদেশকে পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
এ জন্য আগামী ২৩ ও ২৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ‘ক্লাইমেট লিডারস সামিট’ নামে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সম্মেলনটি ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে। এতে যোগ দিতে ৪০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জো বাইডেন।
আবদুল মোমেন বলেন, ‘মূলত এসব কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জলবায়ু বিষয়ক ওই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাতে সশরীরে ৯ এপ্রিল ঝটিকা সফরে ঢাকা আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি।’
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, যে সম্মেলন ভার্চুয়ালি হবে, এই মহামারির মধ্যে সেটার আমন্ত্রণপত্র হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা নয়। ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল বাস্তবায়নেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসনকে পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন। এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি ইস্যুতে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। একইসঙ্গে ভারত, জাপান, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার চতুর্দেশীয় সামরিক জোট কোয়াডে বাংলাদেশকে অন্তর্ভূক্ত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এতে পশ্চিমা এ দেশটির সঙ্গে সমান চেষ্টা চালাচ্ছে প্রধান উন্নয়ন অংশীদার জাপান। চীনের সঙ্গে বিরোধের কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারত আগে থেকেই সামরিক জোটে নিতে চায় বাংলাদেশকে। এদের সবার লক্ষ্য চীনকে ঠেকানো।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট গত ৩১ মার্চ জানিয়েছে, আসন্ন ক্লাইমেট লিডারস সামিট এবং কপ-২৬ (বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন) সম্মেলনের ভালো অগ্রগতি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি ১ থেকে ৯ এপ্রিল আবুধাবি, নয়াদিল্লি ও ঢাকা সফর করবেন।
স্টেট ডিপার্টমেন্ট এক বিবৃতিতে বলেছে: ‘জলবায়ুজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় এই বছর আমরা খুব ভালো অগ্রগতি করতে চাই, যা আমাদের জন্য জরুরি। রাষ্ট্রপতির বিশেষ দূত জন কেরি এ বিষয়ে একাধিক দেশ ভ্রমণে বের হওয়ার কারণ হচ্ছে, আমরা যে অগ্রগতি করতে চাই তা সমন্বয়ের জন্য শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে একান্ত বৈঠকের প্রয়োজন রয়েছে, যাতে আমরা সকলে মিলে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে পারি।
‘কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে যাতে সকলে মিলে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখে, বিশেষ দূত জন কেরির এই সফর তা নিশ্চিতের চেষ্টা করবে। এই সফরে জন কেরি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জনস্বাস্থ্য আইন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাও পর্যবেক্ষণ করবেন। তবে এই সফরে তারা অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন।’
স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা জেমস দিউয়ে বলেন, ‘যেহেতু এটা করোনাকাল, তাই এই সফরে জন কেরি খুবই সতর্ক থাকবেন। এই সফরে যাদের সঙ্গে তার বৈঠক হবে, তাদের সঙ্গে আগে থেকেই কথা বলে বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে।’
কূটনৈতিক মহল মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং চীনের নেতৃত্বে রোড অ্যান্ড বেল্ট উদ্যোগসহ একাধিক বৈশ্বিক উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশিদার। ভৌগলিক অবস্থানই বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। বিশ্বের ২৬ ভবিষ্যত শক্তির মধ্যেও বাংলাদেশ ১৮তম। তাই ১ নম্বর শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং দুই নম্বর শক্তি চীনসহ জাপান, ভারত, অষ্ট্রেলিয়া সবাই বাংলাদেশকে পাশে চায়।
বাংলাদেশ সবার সঙ্গে উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক জোটে থাকতে চাইলেও কোনো সামরিক জোটে আগ্রহী নয় বলে একাধিকবার জানিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এসে সবার চাপ ঢাকার ওপর বেড়েছে। মার্কিন একজন উপমন্ত্রী সাম্প্রতিককালে ঢাকা সফরে এসে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে তাদের আগ্রহের কথা আবার জানান। একই সময়ে জাপানের পররাষ্ট্র সচিব দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে তাদের আগ্রহের কথা জানান।
তবে কেরির সফরকে বাংলাদের জন্য গর্বের বলে মনে করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘উনি না আসলেও পারতেন। কিন্তু উনি প্রধানমন্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। এতে আমরা খুবই গর্ব ফিল করছি। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন জলবায়ু ইস্যুকে বড়ই গুরুত্ব দিচ্ছে।
‘বাইডেন শপথ নিয়েই জন কেরিকে তার জলবায়ু উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্যারিস চুক্তি নিয়ে গভীরভাবে কাজ করেছেন। বলতে গেলে তার চেষ্টাতেই ২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে জলবায়ু চুক্তি (প্যারিস এগ্রিমেন্ট) হয়েছিল।’
যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টার সঙ্গে আগে একাধিকবার কথা হয়েছে জানিয়ে মোমেন বলেন, ‘বাইডেন শপথের পরই কেরি আমাকে ফোন কল করেছিল। সেই সময় থেকেই তারা আমাদের সঙ্গে জলবায়ু ইস্যু নিয়ে কাজ করতে চায় বলে জানান।
‘এরপরও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমার আমেরিকা সফরেও তার সঙ্গে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে বড়ই উদগ্রীব।’
কেরির সফরের সময় বাংলাদেশ প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেবে বলে জানান মোমেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বৈশ্বিক উষ্ণতা দেড় ডিগ্রিতে নামিয়ে আনার বিষয়ে জোর দেব। একইসঙ্গে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী উন্নত ও শিল্পন্নোত দেশগুলো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে যে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বাস্তবায়নের জন্য চাপ দেব।’