কওমি ঘরনার রাজনৈতিক নেতা মামুনুল হক তার রিসোর্টকাণ্ডকে ঘিরে হেফাজতে ইসলামে যে ভাঙনের শঙ্কা করছেন, সেটি তার আধা ঘণ্টার ফেসবুক লাইভের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে।
সংগঠনের সঙ্গীদেরকে তিনি এই বলে সতর্ক করেছেন যে, এখন তাকে ধরা হয়েছে, নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হলে পরে অন্য কাউকে যে ধরা হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই।
মার্চের শেষে দেশের নানা স্থানে তাণ্ডব চালানো ধর্মভিত্তিক সংগঠনটির এ যুগ্ম মহাসচিব সরকারের কাছে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ এর বার্তা দিয়েছেন। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের রিসোর্টকাণ্ডে বিপাকে পড়ার পাঁচ দিন পর বৃহস্পতিবার বিকেলে তৃতীয় দফায় ফেসবুক লাইভে আসেন তিনি। কথা বলেন ৩২ মিনিট।
এই লাইভে রিসোর্টে ঝর্ণাকে তার প্রকৃত স্ত্রী আমিনা তাইয়্যেবা পরিচয় দেয়ার কারণ হিসেবে ভয় পাওয়ার কথা জানান। স্ত্রী ও ঝর্ণা বিষয়ে যেসব ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, সেগুলো ফেসবুকে আসায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, তিনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন।
স্ত্রী আমিনা তাইয়্যেবাকে ঝর্ণার বিষয়ে অসত্য তথ্য দেয়ার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে তিনি বলেন, স্ত্রীর সঙ্গে সীমিত পরিসরে অসত্য বলার সুযোগ আছে।
নানা স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ এই ফেসবুক লাইভে তিনি নিজ সংগঠন হেফাজতে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানান তার ওপর আস্থা রাখতে। বলেন, হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্ব তাকে সংশোধনের সুযোগ করে দিতে পারে।
হেফাজতের ঐক্যে জোর
নিজের সঙ্গে রিসোর্টের সঙ্গীনি ও স্ত্রীর সঙ্গে তার বোনের পাশাপাশি রিসোর্ট কাণ্ড নিয়ে হেফাজত নেতাদের যে কথোপকথন ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, সেগুলো নিয়েও কথা বলেন মামুনুল।
একাধিক কথোপকথনে এটা স্পষ্ট যে, মামুনুল যে দ্বিতীয় বিয়ের দাবি করেছেন, সেটির সত্যতা নিয়ে খোদ হেফাজতেই প্রশ্ন আছে। মামুনুলকে হেফাজত থেকে বাদ দেয়ার আলোচনাও আছে।
মামুনুল বলেন, ‘দায়িত্বশীলদের পারস্পরিক বিভিন্ন কথাবার্তা আলাপ আলোচনাগুলোর গোপন রেকর্ড ফাঁস করার যে ধারাবাহিক সিরিজ শুরু হয়েছে, এর মাধ্যমেও তাদের অশুভ উদ্দেশ্য দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট হয়েছে।
‘তারা চাচ্ছে, হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বকে কলুষিত করতে। তারা চাচ্ছে, হেফাজতে ইসলামের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহ তৈরি করতে, সর্বোপরি হেফাজতে ইসলামকে দুর্বল করে দিতে।’
নারায়ণগঞ্জে রয়্যাল রিসোর্টে অবরুদ্ধ হয়ে সঙ্গীনি নারীকে দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করা নিয়ে হেফাজতে ইসলামেই নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছেরিসোর্টকাণ্ডের পরেও হেফাজতে কোনো বিভেদ তৈরি হবে না বলে আশা করে তিনি বলেন, ‘আমি অত্যন্ত আস্থা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি, ইনশাআল্লাহ হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় ও অটুট থাকবে।
‘আমাদের মধ্যকার এই পারস্পরিক ভেদাভেদ আমরা ভুলে যাব। যদি আমরা কেউ কোনো দোষ করে থাকি, তাহলে তা সাংগঠনিকভাবে সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং যে কোনো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গ্রহণ করবে।’
তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী রয়েছেন, সম্মানিত মহাসচিব রয়েছেন, তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত হেফাজতে ইসলামের বিষয়ে গ্রহণ করবেন।’
হেফাজতে ভাঙন ধরলে পরিণতি কী হবে, তা নিয়েও কথা বলেন মামুনুল। বলেন, ‘যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশ এবং ইসলামকে রক্ষা করার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। দেশবিরোধী যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।
‘গতকাল আমাকে হেয় করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। আজ রফিকুল ইসলাম মাদানীর চরিত্র হননের অপচেষ্টা করা হচ্ছে। আগামীকাল কে টার্গেট হবেন, সেটা আল্লাহই ভালো জানেন।’
রিসোর্টকাণ্ডের পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার লক্ষ্য ব্যক্তি মামুনুল নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘উদ্দেশ্য হলো এখানে ইসলামের পক্ষের কণ্ঠগুলোকে স্তব্ধ করে দেয়া।
‘ইসলামের প্রতিনিধিত্ব যারা করেন, আলেম-ওলামাকে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং ইসলাম পন্থাকে বাংলাদেশে দুর্বল করে দেয়া। এটাই হলো চলমান বহুমুখী সাঁড়াশি আক্রমণের মুখ্য উদ্দেশ্য।’
শিশুবক্তা হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি তুলে ধরেও হেফাজতকে সতর্ক করেন মামুনুলমামুনুল বলেন, ‘পরিস্থিতি এভাবেই চলতে থাকলে এই জনপদে কোনো সম্মানিত মানুষ নিজের সম্মান-মর্যাদা নিয়ে, ব্যক্তিগত জানমাল ইজ্জত এবং আব্রুর নিরাপত্তা নিয়ে জনপদে চলতে পারবেন না।’
তিনি বলেন, ‘দেশ এবং জাতির এই পরিস্থিতিতে আমি ব্যক্তিগতভাবে গভীর উৎকণ্ঠিত এবং উদ্বিগ্ন। তাই এই উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা থেকে জাতিকে মু্ক্ত করার জন্য প্রত্যেককে যার যার জায়গা থেকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা ছাড়া মুক্তির বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই।’
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আহ্বান
হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ‘সকল মহলকে আহ্বান জানাব, আসুন বিশ্বে কোভিড নাইনটিন এর যে ভয়াবহ পরিবেশ বিরাজ করছে, এই পরিস্থিতিতে আমরা দেশবাসী সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই সকল মহলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। কেউ কারও ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করব না। অন্য কারও সঙ্গে মতের অমিল থাকতে পারে, রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে, সেখানে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবেন, কোনো আদর্শিক ভিন্নতা থাকতে পারে, আদর্শিকভাবে আপনি আপনার যুক্তিতর্কসহ ভিন্ন মতাদর্শকে মোকাবিলা করবেন।’
মার্চের শেষে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালেওফেসবুকে ফাঁস হওয়া কথোপকথন তাদের নিজেদের স্বীকার করে একে তার চরিত্র হনন করার ‘কাপুরুষোচিত’ পদ্ধতি, ‘নিচু মানসিকতার’ একটি পন্থা বলেও বর্ণনা করেন মামুনুল।
বলেন, ‘আমরা আশা করব যে সংশ্লিষ্ট সকলেই এই নিচু মানসিকতা পরিহার করে মানবতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন।’
ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় গুরুত্বারোপ
হেফাজত নেতা বলেন, ‘অন্যের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত মানসম্মানকে যদি আপনি গুরুত্ব দেন, অন্যের সম্মান যদি আপনি রক্ষা করেন, আপনার সম্মান আল্লাহপাক রক্ষা করবেন, আপনি যদি অন্যের সম্মান বিনষ্ট করার চেষ্টা করেন, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যদি আপনাকে অসম্মানিত করতে চান, তাহলে আপনার জন্য ভয়াবহ হবে।’
টেলিফোনালাপ ও রিসোর্টের সঙ্গী জান্নাত আরা ঝর্ণার ভিডিও ফাঁসের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও দায়ী করেন মামুনুল। বলেন, ‘আমি অনুরোধ করব, আপনারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাষ্ট্রের সেবক, কোনো ব্যক্তি বা দলের সেবাদাস নন। কাজেই আপনারা আপনাদের পেশাগত দায়িত্ব আমানতদারের মতো পালন করবেন। কারও কোনো চাপের কাছে যদি আপনারা নত হয়ে ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষুন্ন করেন, মনে রাখবেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে রোজ হাসরে জবাবহিদিতা করতে হবে।’