করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সাত দিনের লকডাউন ঘোষণায় বন্ধ আছে বিপণিবিতান ও দূরপাল্লার যান। এ ছাড়া পুরো দেশে বিরাজ করছে স্বাভাবিক চিত্র। প্রশ্ন উঠছে এ কেমন লকডাউন?
বিপণিবিতান বন্ধ আছে ঠিকই, কিন্তু খুলে দেয়ার দাবিতে চার দিনে ধরে ব্যবসায়ীরা বিক্ষোভ করছেন। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে সংক্রমণ ঠেকাতেই যখন লকডাউন, তখন মার্কেটের সামনে গণজমায়েত করে চলছে বিক্ষোভ।
দুই দিন ধরে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও তৃতীয় দিনে সড়কে ফিরেছে বাস। তাতে জনভোগান্তি কমেছে। কিন্তু কমেনি সংক্রমণের ভয়াবহতা।
সড়কে বাস নামতেই ঢাকা ফিরেছে চিরচেনা রূপে। বুধবার বেলা যত বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজধানীর সড়কে বেড়েছে মানুষের সংখ্যা। বিধিনিষেধের কোনো তোয়াক্কা ছিল না কারও মধ্যে।
এরই মধ্যে সোমবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, লকডাউন আরও বাড়ানো হবে কি না, এ বিষয়ে আগামী বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
সচিব তখন বলেছিলেন, ‘মানুষকে কো-অপারেট করতে হবে। আমরা সে কথা বারবার বলছি। সবাই যদি মাস্ক ইউজ করে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, তাহলে অসুবিধা হওয়ার কথা না।’
লকডাউন বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সচিব বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা বলেছি কিন্তু, আমরা লকডাউন ঠিক বলিনি।’
সরকারের নির্দেশনায় বলা ছিল, উন্মুক্ত স্থানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও কাঁচাবাজার ছাড়া বন্ধ থাকবে সব দোকানপাট ও বিপণিবিতান। এরপরও অনেক স্থানে দোকান খোলা থাকতে দেখা গেছে। অলিগলির ভেতরের সব দোকানই খোলা চোখে পড়ে।
রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে। তবে নিয়ম মানায় বাধ্য করতে তাদের তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি।
লকডাউনে সরকারি নির্দেশনা কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা জানতে নিউজবাংলার প্রতিবেদকরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখেছেন। কোথাও মানা হয়নি কোনো নিয়ম কানুন। মূল সড়ক লাগোয়া দোকানপাট বন্ধ থাকলেও খোলা ছিল পাড়া ও অলিগলির সব দোকানপাট।
অনেককেই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে রাস্তায় বের হতে দেখা গেছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কোনো তাগিদ নেই। মাস্ক নেই বেশির ভাগ মানুষের মুখে। কারও কারও মাস্ক ঝুলেছে থুতনি বা গলায়।
এর আগের দুই দিন সড়কে কোনো বাস ছিল না, তবে তাতেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি পরিস্থিতি। অফিস খোলা থাকায় সকাল থেকেই রাস্তায় নামতে থাকে মানুষ। মোড়ে মোড়ে বাসের জন্য জমায়েত হতে দেখা যায় তাদের।
সরকারের বিধিনিষেধে বলা হয়েছিল, সকল প্রকার গণপরিবহন সড়ক রেল ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বন্ধ থাকবে। তবে পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যবস্থা, জরুরি সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না।
কিন্তু এর কোনো কিছু কার্যকর ছিল না প্রথম দুই দিন। লকডাউনের প্রথম দিনে রাজধানীতে গণপরিবহন ছাড়া সব ধরনের যানবাহন চলেছে। কলকারখানা ও বিভিন্ন অফিস খোলা থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপস বন্ধ থাকলেও নগরীর মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করেছে মোটরসাইকেল চালকরা। অবাধ চলাচল ছিল সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশার। এ ছাড়া বিভিন্ন সড়কে লেগুনাও চলাচল করেছে।
বুধবার নির্বিঘ্নে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার সেবা চালু রাখার দাবিতে দুপুর পৌনে একটার দিকে মগবাজার চৌরাস্তায় সমবেত হন কয়েক শ রাইড শেয়ারিং চালক। এ সময় তারা রাইড শেয়ার চালুর দাবিতে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। অবরোধ করেন সড়ক।
বিক্ষোভের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট বাঁধে। এর মধ্যে এয়ারপোর্ট রোড, বাংলামোটর রোড, কাকরাইল রোড ও মৌচাক রোডে যানজটের সৃষ্টি হয়।
যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে কোথাও কোথাও।
সরকারের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোনো রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খাওয়া যাবে না। বাসায় কিনে নেয়া যাবে। সেটাও মানা হচ্ছে না। রাজধানীর বেশির ভাগ খাবারের দোকানে বসে খেতে দেখা গেছে মানুষজনকে।
লকডাউনের নামে যা হচ্ছে তা নিয়ে ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট ডা. নজরুল ইসলাম।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দিকে সরকার কিংবা জনগণ কেউই গুরুত্ব দিচ্ছে না জানিয়ে এই ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সরকারের এদিকে কোনো লক্ষ্য নেই। সংক্রমণ ঠেকানোর সবচেয়ে বড় বিষয় স্বাস্থ্যবিধি পালন করা। কিন্তু সেই বিষয়ে যা যা করার তা করছে না সরকার।
‘করোনা পজিটিভ হলে তাকে আইসোলেশন করা, কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, এলাকাভিত্তিক রেড জোন চিহ্নিত করা এইগুলো কিছুই হচ্ছে না।’
স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোর দাবি রেখে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে। বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মানানোর কোনো লক্ষণ নেই, কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে দোকান বন্ধ, গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
অধ্যাপক নজরুল বলেন, ‘সাপের খেলা খেলছেন তো আপনাকে সাপের মন্ত্র ভালো করে বুঝতে হবে। কিন্তু আপনি তা করছেন না। এটা তো খারাপ হবে। স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে। এর বিকল্প নেই।’