করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় সাত দিনের লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে রাজধানীতে জীবনযাত্রা আরও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানতে দেখা যায়নি অনেককেই।
মঙ্গলবার বেলা যত বেড়েছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজধানীর সড়কে বেড়েছে মানুষের সংখ্যা। বিধিনিষেধে গণপরিবহন বন্ধের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকায় এদিনও দেখা যায়নি বাস চলতে। তবে অন্য সব গাড়ি চলতে দেখা গেছে।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, উন্মুক্ত স্থানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও কাঁচাবাজার ছাড়া বন্ধ থাকার কথা সব দোকানপাট ও বিপণিবিতান। এরপরও অনেক স্থানে দেখা গেছে দোকান খুলতে। অলিগলির ভেতরের প্রায় সব দোকানই খোলা চোখে পড়ে।
রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে। তবে নিয়ম মানায় বাধ্য করতে তাদের তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি।
লকডাউনে সরকারি নির্দেশনা কেমন মানা হচ্ছে, তা দেখতে এই প্রতিবেদক সকাল ১০টায় মৌচাক থেকে রিকশা নিয়ে রাজধানীর মগবাজার, বেইলি রোড, শান্তিনগর, মালিবাগ, বাংলামোটর ও কাকরাইল এলাকায় প্রায় দেড় ঘণ্টা অবস্থান করেন। এসব এলাকায় শুধু বাস বন্ধ দেখা গেছে। অন্য সব যান স্বাভাবিক নিয়মেই চলেছে।
অফিসগামী অনেককে দেখা গেছে রিকশা ও মোটরসাইকেল ব্যবহার করতে।
সকালে রাজধানীর সড়কে মাঝে মাঝে দুই-একটি বাস চলতে দেখা গেছে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা।
অনেককেই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে রাস্তায় বের হতে দেখা গেছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কোনো বালাই ছিল না রাস্তায়।
লকডাউন পরিস্থিতি নিয়ে রমনা জোনের এডিসি ফাইজুর রহমান বলেন, ‘রমনা ডিভিশনে যেসব কাঁচাবাজার আছে। যেমন, হাতিরপুল আছে, নিউমার্কেট আছে। এগুলো বড় জায়গায়। এগুলো কনজাসটেস্ট না। কাঁচাবাজার মালিক সমিতি, কর্মচারী সমিতি আছে তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। তারা স্বেচ্ছা সেবক নিয়োগ করছেন।
‘আমরা এসব জায়গায় ফিল্টারিং করে ঢুকানোর চেষ্টা করছি। বাজারের ভেতরে দোকানদার ও ক্রেতা যারা আছেন তারা যেন মাস্ক পরেন সে বিষয়টি দেখভাল করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এলাকার মধ্যে কোন হোটেলে বসে খেতে দিচ্ছি না। পার্সেল এবং অনলাইন ডেলিভারি যে সার্ভিস আছে সে ধরনের হোটেল খোলা আছে। এ ছাড়া চায়ের দোকানসহ আড্ডার জায়গা যেসব আছে সেগুলো বন্ধ আছে। আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছি লকডাউনের সুফল জনগণকে বুঝানোর।’
নিত্য প্রয়োজনীয় ছাড়া সব ধরনের দোকান পাট বন্ধ আছে বলেও তিনি জানান।
বেচাকেনা
বিভিন্ন গলিতে সবজি, মাছ ও মুরগি বিক্রেতারা অন্য দিনের মতোই বেচাবিক্রি করছেন। মালিবাগ এলাকার সবজি বিক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, ‘প্রথমে রাস্তায় ভ্যান নিয়ে ছিলাম। পরে পুলিশ দেইখ্যা গলির ভেতরে ঢুইকা গেছি।’
সিদ্ধেশ্বরী এলাকার গলিতে আরিফ হোসেন নামে এক মুদি দোকানি জানান, লকডাউন তাদের জন্য নয়। তারা নিয়ম মেনেই ব্যবসা করছেন।
রাজধানীর অনেক প্রধান সড়ক সংলগ্ন এলাকায় দোকানপাট খোলা রেখেছেন অনেকেই। মিষ্টির দোকান, ইলেকট্রনিকস পণ্যের দোকান ছাড়াও খোলা ছিল সুপার শপ।
খাবার অনেক দোকান খোলা রয়েছে দ্বিতীয় দিনেও। দোকানের শাটার নামানো থাকলেও ভেতরে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে।
দুর্ভোগ নিয়ে অফিসযাত্রা
অফিসগামী অনেককেই সকালে বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। অনেক অফিসে পরিবহনব্যবস্থা না থাকায় রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা হয়ে উঠেছে ভরসা।
অনেক অফিসগামী লোক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকে নিউজবাংলাকে জানান, অফিস কোনো গাড়ির ব্যবস্থা করেনি; জানিয়ে দিয়েছে রাস্তায় বাস ছাড়া সব পরিবহন আছে, তাই অফিসে যেতেই হবে।
লকডাউনে নির্দেশনা
দেশে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় করোনা সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকে। শনাক্ত ৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এমন অবস্থায় ৩ এপ্রিল সরকার সাত দিনের লকডাউন ঘোষণা করে।
পরের দিন প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে ৫ থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত অবশ্যই পালনীয় হিসেবে ১১ দফা দিয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশনাগুলো হলো—
১. সকল প্রকার গণপরিবহন সড়করেল ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বন্ধ থাকবে। তবে পণ্য পরিবহন, উৎপাদনব্যবস্থা, জরুরি সেবাদানের ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না। এ ছাড়া বিদেশগামী, বিদেশ প্রত্যাগত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না।
২. আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা যেমন: ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস বা জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরসমূহের (স্থলবন্দর, নদীবন্দর ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, ডাকসেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এই নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।
৩. সকল সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও আদালত এবং বেসরকারি অফিস কেবল জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবল প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় অফিসে আনা-নেয়া করতে পারবে। শিল্পকারখানা ও নির্মাণ কার্যাদি চালু থাকবে। শিল্পকারখানার শ্রমিকদের স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেয়া করতে হবে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কর্তৃক শিল্পকারখানা এলাকায় নিকটবর্তী সুবিধাজনক স্থানে তাদের শ্রমিকদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন বা সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবে বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না।
৫. খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় কেবল খাদ্য বিক্রয়/সরবরাহ (Takeway/Online) করা যাবে। কোনো অবস্থাতে হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ করা যাবে না।
৬. শপিং মলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে। তবে দোকানগুলো পাইকারি ও খুচরা পণ্য অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই সর্বাবস্থায় কর্মচারীদের মধ্যে আবশ্যিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং কোনো ক্রেতা স্বশরীরে যেতে পারবে না।
৭. কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
৮. ব্যাংকিং ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
৯. সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ঢাকায় সুবিধাজনক স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
১০. সারা দেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন উল্লেখিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত টহল জোরদার করবে।
১১. এই আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।