নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের রিসোর্ট-কাণ্ডের পর তুমুল আলোচনা-সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তার দ্বিতীয় ‘বিয়ে’ বৈধ বলে জানিয়েছেন ধর্মভিত্তিক দলটির নেতারা। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতারা সোমবার জরুরি বৈঠক শেষে এ কথা জানান।
রাজধানীতে জামিয়া রাহমানিয়ায় এই জরুরি বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল হামিদ পীর সাহেব মধুপুরী।
নেতারা বলেছেন, ‘মাওলানা মামুনুল হক ৩ এপ্রিল তার স্ত্রীকে নিয়ে সোনারগাঁয়ে (রয়্যাল) রিসোর্টে গিয়েছিলেন। ইসলামি শরিয়তের আলোকে তার বিবাহ পরিপূর্ণ শুদ্ধ মর্মে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই।’
তারা আরও বলেন, ‘দেশের যেকোনো নাগরিক তার স্ত্রী-পরিবার নিয়ে যেকোনো স্থানে যাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু মাওলানা মামুনুল হকের মতো পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তির ওপর সন্ত্রাসীরা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি এবং অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। জাতীয় সংসদে একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয়কে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এটা জনগণ কখনোই আশা করেনি। আমরা এ বক্তব্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাই।’
নেতারা আরও বলেন, ‘গত ২৬, ২৭, ২৮ মার্চ বাইতুল মোকাররম, হাটহাজারী, বিবাড়িয়া, মুন্সিগঞ্জসহ সারা দেশে হেফাজত কর্মী ও প্রতিবাদী মানুষের ওপর হামলা করা হয়েছে। এতে বিবাড়িয়া ও হাটহাজারীতে ২০ জন শাহাদতবরণ করেছে। এসব হত্যাকাণ্ড ও হামলার বিষয়ে বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের অসংখ্য কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
‘হেফাজত নেতা-কর্মীদের বাসায় বাসায় হয়রানি এবং মাদ্রাসাসমূহে হামলা ও হায়রানির ঘটনা ঘটছে, তা বন্ধ করতে হবে। শহিদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের খোঁজখবর নিতে হেফাজতের কেন্দ্রের পক্ষ থেকে একটি টিম শিগগিরই বিবাড়িয়া ও হাটহাজারী সফর করবে এবং হতাহতের একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে।’
নেতারা আরও বলেন, ‘মুন্সিগঞ্জের সিরাজদীখানের মধুপুরে গত হরতালের দিন সরকারদলীয় ক্যাডার ও পুলিশ বাহিনী যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তা বর্ণনাতীত। হেফজাতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল হামিদ মধুপুরীকে গুলি করে আহত করা হয়েছে। তার পরেও সেখানকার স্থানীয় জনগণকে বিভিন্নভাবে হুমকিধমকি দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার মুন্সিগঞ্জ কুচিয়ামারাতে হেফাজতে ইসলামের উদ্যোগে দেশব্যাপী হত্যা ও হামলা-মামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।’
হেফাজতের সভায় উপস্থিত ছিলেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম, উপদেষ্টা মাওলানা আবুল কালাম, নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল আউয়াল, মাওলানা মাহফজুল হক, অধ্যাপক আহমদ আব্দুল কাদের, মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা ফজলুল করিম কাসেমী, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, মাওলানা খুরশিদ আলম কাসেমী, মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, মাওলানা হাসান জামিল, মাওলানা জসিমউদ্দীন, মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, মাওলানা মুসা বিন ইজহার, অর্থ সম্পাদক মাওলানা মুনির হোসাইন কাসেমী, ঢাকা মহানগর সহসভাপতি মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন, সহপ্রচার সম্পাদক ফয়সাল আহমদ, সহ অর্থ সম্পাদক মাওলানা জাকির হোসাইন কাসেমী, সহকারী সমাজকল্যান সম্পাদক মাওলানা গাজী ইয়াকুব, ঢাকা মহানগর সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুর রহমান হেলাল, মাওলানা ফজলুর রহমানসহ অনেকে।
মামুনুল হক গত শনিবার এক নারীকে নিয়ে সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন তাকে ঘেরাও করে। মামুনুল ওই নারীকে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করলেও তার নাম, শ্বশুরবাড়ি, শ্বশুরের নাম সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন, তার সঙ্গে সেই নারীর দেয়া তথ্যের কোনো মিল নেই।
মামুনুল বলেছেন, তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম আমেনা তইয়্যেবা। বাড়ি খুলনায়, শ্বশুরের নাম জাহিদুল ইসলাম।
তবে সেই নারী জানিয়েছেন তার নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা বাবার নাম অলিয়র, গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়।
দুজনের তথ্যের এই গরমিলের মধ্যেই বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোনে কথোপকথনের অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হয়। এর একটিতে বোঝা যায় মামুনুল তার চার সন্তানের জননী স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, সেই নারী তার পরিচিত শহীদুল ইসলামের স্ত্রী। ঘটনার কারণে চাপে পড়ে তাকে স্ত্রী পরিচয় দিতে বাধ্য হয়েছেন।
পরে আরেকটি কথোপকথন ফাঁস হয়, যা মামুনুলের সঙ্গে তার রিসোর্টের সঙ্গীনির মধ্যকার বলে প্রতীয়মান হয়। সেখানে সেই নারী জানান, তিনি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তার মায়ের একটি বন্ধ মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। আর অন্য একজন যখন তাকে কোথায় বিয়ে হয়েছে জিজ্ঞেস করেছে, তখন তিনি বলেছেন, এটা জানেন না। মামুনুলের সঙ্গে কথা বলে নেবেন।
আরও একটি কথোপকথনে বোঝা যায় মামুনুলের বোন কথা বলেছেন হেফাজত নেতার চার সন্তানের জননী স্ত্রীর সঙ্গে। তিনি তাকে বুঝিয়েছেন, কেউ যদি তাকে ফোন করে, তাহলে তিনি যেন বলেন, তিনি বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন এবং তার শাশুড়ি এই বিয়ের আয়োজন করেছেন।
এরপর মামুনুল ফেসবুক লাইভে এসে বলেন, তিনি বিয়ে করেছেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রীকে। পারিবারিকভাবেই এই বিয়ে হয়েছে।
পরদিন ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি একে একটি মানবিক বিয়ে উল্লেখ করে লেখেন, সেই নারীর সঙ্গে তার স্বামীর ছাড়াছাড়ির আগে তিনি সংসার টেকানোর চেষ্টা করেছেন। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর মেয়েটি দুর্দশায় পড়ে যায়। সে সময় তিনি বিয়ে করে নিয়েছেন তাকে।
এরই মধ্যে ফেসবুকে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন ঝর্ণা ও শহীদুলের বড় ছেলে আব্দুর রহমান জামি। সে তার মা-বাবার সংসার ভাঙার জন্য মামুনুলকে দায়ী করে বলে, ‘এখানে আমি আশা করব, আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আশা করব এর যেন সঠিক বিচার হয়, আপনারা কারও অন্ধ ভক্ত হয়েন না।
‘কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস কইরেন না। ক্যান, সবারই মুখোশের আড়ালে একটা চেহারা থাকে। এই লোকটা আলেম নামধারী একটা মুখোশধারী একটা জানোয়ার। এর মধ্যে কোনো মানুষত্ব নাই। সুযোগের সব সময় অপেক্ষায় থাকে। কাকে কীভাবে দুর্বল করা যায়। আমার আর কিছু বলার মতো ভাষা নাই।’