করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সারা দেশে সোমবার থেকে সাতদিনের লকডাউন শুরু হচ্ছে। লকডাউন ঘোষণার পর শনিবার দুপুরের পর থেকেই রাজধানী ছাড়তে শুরু করে মানুষ।
রোববার সকাল থেকে বাড়ি ফিরতি মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে বাস টার্মিনালে।
দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকেও দূরপাল্লার বাসের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। গণপরিবহনে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে চলাচলের কারণে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর পরও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেন যাত্রীরা।
বাসের ভেতর দুই আসনে একজন যাত্রী বহন করে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও টিকেট কাউন্টার গুলোতে তা মোটেও দেখা যায়নি। গা ঘেঁষে, ভিড় করে টিকেট নিচ্ছেন তারা। অনেকের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। তবে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ মানা হচ্ছে কিনা তা তদারকির জন্য একাধিক মনিটরিং টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার।
সরকার এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করলেও আবারও সবকিছু স্বাভাবিক হবে কী না এই অনিশ্চিয়তায় রাজধানী ছাড়ছেন অনেক। বিশেষ করে কর্মহীন মানুষ, শিক্ষার্থীরা শহর ছাড়ছেন। আবার কেউ কেউ পরিবারের নারী সদস্য ও সন্তানদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
রাজধানীর গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল ঘুরে এ দৃশ্য দেখা গেছে। গাবতলী বাস টার্মিনালে রোববার সকাল থেকেই যাত্রীদের উপস্থিতি ছিল সাধারণ দিনের তুলনায় অনেক বেশি। প্রায় প্রতিটি কাউন্টারের সামনে যাত্রীদের ভিড়। শহর ছেড়ে কেউ যাচ্ছেন একা আবার কেউ পরিবারসহ। কিছু সময় পর পরই বাসস্ট্যান্ড থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যাচ্ছে।
ঢাকা থেকে গাইবান্ধা যাচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ার আফনান। তিনি বলেন আমার কর্মস্থল ঢাকা ও গাইবান্ধা দুই জায়গায়। আমার আগামীকাল গাইবান্ধা যাওয়ার কথা ছিল। সোমবার থেকে লকডাউন থাকায় আমি আজকে যাচ্ছি।
স্ত্রীকে দিনাজপুর পাঠাচ্ছেন বেসরকারি অফিসে কর্মরত আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাড়িতে মা একা। তার দেখাশোনার জন্য স্ত্রীকে রমজানের আগেই পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ ঘোষিত এই লকডাউন যদি আরও বাড়ানো হয়। তবে বাড়ি যেতে পারে কিনা সেই আশঙ্কাই আজকেই তাকে পাঠাচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে সেই খবরে মার্চে নতুন করে ম্যাচ ভাড়া করেছিলেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়হান আমিন। তিনি বলেন, আমি যাদের সঙ্গে মেসে থাকি তারা সবাই যার যার বাড়িতে চলে যাচ্ছে। তাই আমিও বাড়ি যাচ্ছি। শুধু শুধু ঢাকায় থেকে কি করব।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও বাসের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অনেক যাত্রী। ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার জন্য সকাল থেকে অপেক্ষা করেও দুপুরের পর টিকিট পেয়েছেন বলে জানান চুয়াডাঙ্গার ব্যবসায়ী কৌশিক। তিনি বলেন, চুয়াডাঙ্গাতে আমার ব্যবসা রয়েছে। ঢাকায় একটি কাজে এসেছিলাম এখন চলে যাচ্ছি।
৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর পর আরও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছে শিক্ষার্থী নাজমুল। তিনি বলেন, ৪০০ টাকার টিকিট ৮০০ টাকায় কিনেছি। কাউন্টারে টিকিট নাই। পরিবহনের স্টাফরা কাউন্টারের বাইরে ডেকে ডেকে বেশি দামে টিকিট বিক্রি করছেন।
লকডাউনের আগের দিন যাত্রীদের অতিরিক্ত ভিড় প্রসঙ্গে হানিফ পরিবহনের কাউন্টার-মাস্টার জহিরুল ইসলাম জানান অতিরিক্ত বাস দিয়েও যাত্রীদের চাপ সামলাতে পারছিনা। ধারণক্ষমতার অর্ধেক আসন সংখ্যা আর যাত্রীসংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় একটু ঝামেলা হচ্ছে।
মহাখালী বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত যাত্রীদের চাপ কিছুটা কম ছিল। তবে দুপুর থেকে সেটা বাড়তে শুরু করেছে।
ঢাকা থেকে নেত্রকোণাগামী পরিবহন শাহজালালের কাউন্টার-মাস্টার আব্দুল আলীম বলেন, আমাদের গাড়িতে নিয়মিত যাত্রী থাকে। আজকে যাত্রীদের চাপ অনেক বেশি।
ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে চলাচলকারী এনা পরিবহনের কাউন্টারের সামনে সকাল থেকেই ছিল যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন। গাড়ির ভেতর অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করা না গেলেও টিকিট কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইনে ছিল না কোনও স্বাস্থ্যবিধি। অনেককেই মাস্ক পড়তে দেখা যায়নি। টিকিটের লাইনে ছিল না সামাজিক-দূরত্ব মানার কোনও বালাই।
ময়মনসিংহ শহরের সানকিপাড়ার বাসিন্দা শাকিলুর রহমান বলেন, ইস্ট-ওয়েস্ট এ পড়াশোনা করি। ভাই-ভাবির সঙ্গে ঢাকায় থাকি। লকডাউন দেয়ার ও ঢাকায় কোন কাজ না থাকায় বাড়ি চলে যাচ্ছি।
সরেজমিনে টার্মিনালের পরিস্থিতি দেখতে বেলা দেড়টার দিকে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার গাবতলী বাস টার্মিনালে আসেন। এ সময় তিনি টার্মিনালে বিভিন্ন কাউন্টার ঘুরে ঘুরে দেখেন। রাস্তায় চলমান বাস থামিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কিনা তা পরিদর্শন করেন তিনি। যাত্রীদের পরামর্শ দেন কোন অসুবিধা হলে এখানে থাকা ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
এর আগে সকাল থেকে অভিযান চালিয়েছে বিআরটিএ। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে দুটি পরিবহনকে জরিমানা করা হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানায় ৮টি মামলা হয়েছে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (আদালত-১০) মোহাম্মদ জোবায়ের আলম বলেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য দুটি পরিবহনকে জরিমানা করা হয়েছে। একটি হচ্ছে শুকতারা পরিবহন, অন্যটি এস বি লাইন। আমাদের টিম এখানে আছে। অভিযোগ পাওয়া মাত্রই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখন পর্যন্ত আটটি মামলায় মোট ছয় হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি বার বার বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমরা যখন এখানে টহল দেই তখন সবকিছু ঠিকঠাকই থাকে। কিন্তু সরে যাওয়া মাত্রই তারা আবার এলোমেলো হয়ে যায়। এখন তাদের সচেতন হওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। ’
এদিকে গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘সরকারের ১৮ দফা নির্দেশনার একটি হচ্ছে ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচল করবে। সেই লক্ষ্যে ঢাকা সিটিতে আমাদের ৮ জন ম্যাজিস্ট্রেট বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করছেন। এরমধ্যে তিন-চারটি টার্মিনালও কাভার করছেন। বর্তমানে আমাদের শুক্রবার ও শনিবারেও মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে। গতকাল আমাদের ঢাকা সিটিতে ২৫ টি মামলা হয়েছে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করে বিভিন্ন বাস-কাউন্টার এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছি। সেখানে ভাড়া বাড়ানোর তেমন কোনও অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তিন চারটা বাসে উঠে পরিদর্শন করেছি। সেখানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখেছি কারও কোনো কমপ্লেন (অভিযোগ) নাই। সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। আগামীকাল থেকে যেহেতু লকডাউন, তাই গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। ’