২০১৯ সালের কথা। বৈশ্বিক অভিযোজন কমিশনের সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকা সফরে আসেন মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের প্রেসিডেন্ট হিল্ডা হেইনে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুনকে সঙ্গে নিয়ে আমি এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিলাম।
আমরা সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারীদের সতর্ক করে বলেছিলাম, যে হারে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, সে তুলনায় বৈশ্বিক অভিযোজন তৎপরতা একেবারেই অপ্রতুল। এর ফলে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলছে, যাদের আশ্রয় দিতে চায় না কেউই। আমরা তাদের এ বলে সতর্ক করেছিলাম যে, দিনশেষে জলবায়ুর এ আক্রোশ থেকে কোনো দেশ বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রেহাই পাবে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ৪৮টি দেশের বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব নিয়ে গঠিত ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতি হিসেবে প্রেসিডেন্ট হেইনে তার দ্বীপরাষ্ট্রের জলবায়ু সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় যে সাহস ও নেতৃত্ব দেখিয়েছিল, তাতে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
জলবায়ু সংকটের কেন্দ্রে থাকা এবং অভিযোজনে বৈশ্বিক পর্যায়ে নেতৃত্বে দেয়া বাংলাদেশকে ২০২০ সালে তিনি সিভিএফ সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব দিলে আমি তা ফেলতে পারিনি।
২০০৯ সালে মালদ্বীপের নেতৃত্বে বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনে বিপর্যস্ত ১০টি দেশ মিলে এই ফোরাম গঠন করার পর আমি দ্বিতীয় দফায় এর দায়িত্ব নিলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার সামান্যতম বৃদ্ধি, নিয়ত ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত কিংবা দ্রুতগতিতে মরুকরণে যাদের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়ে, সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের সেই ১০০ কোটির বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে সিভিএফ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ‘গ্রাউন্ড জিরো’ হিসেবে প্রায়ই উল্লেখ হওয়া বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন লাখ লাখ সহিষ্ণু মানুষের সাহসিকতার সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই। প্রকৃতির রুদ্ররোষে পড়ে বারবার বাড়িঘর, জমিজমা ও ফসল হারাচ্ছেন তারা।
চরমভাবাপন্ন আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ হারায় আমার দেশ। এ শতাব্দী শেষে হারানোর এ হার হবে ৯ শতাংশ।
২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের উপকূল এলাকার ১৭ শতাংশ তলিয়ে যাবে, যাতে বাস্তুচ্যুত হবে তিন কোটি মানুষ। এরই মধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়েছে ৬০ লাখ বাংলাদেশি। এরপরও আমরা মিয়ানমার থেকে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করে চলেছি। এতে বিপর্যস্ত হচ্ছে কক্সবাজারের পরিবেশ-প্রতিবেশ। এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
বাংলাদেশের মতো সিভিএফভুক্ত প্রতিটি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ে বলার মতো গল্প আছে। অথচ বৈশ্বিক মোট কার্বন নিঃসরণের খুবই সামান্য অংশ করে তারা। জলবায়ুজনিত এই অবিচার তুলে ধরার সময় এসেছে।
কপ-২৬সহ বৈশ্বিক জলবায়ু সংক্রান্ত যেকোনো আয়োজনে আমার সভাপতিত্বে থাকা সিভিএফের কণ্ঠস্বর উচ্চকিত করা ও ফোরামটির স্বার্থ তুলে ধরাকে মিশন হিসেবে নিয়েছি।
কঠিন এক সময়ে বাংলাদেশ সিভিএফের সভাপতিত্ব পেয়েছে।
২০২০ সালে বৈশ্বিক উষ্ণতা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল বিশ্ব। অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর দেশগুলো ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জাতীয় পরিকল্পনা তথা এনডিসি পূরণে হিমশিম খাচ্ছিল। ওই বছরসহ বিগত কয়েক বছর জলবায়ু নিয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় অগ্রাধিকার কমিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্যারিস সম্মেলনে প্রতিশ্রুত অর্থের অনেক কম আদায় হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে কম কার্বন নিঃসরণ হওয়া প্রকল্পে সহায়তার অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী কার্বন মার্কেটগুলোতে অর্থায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আছে বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমনের প্রায় ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী জি-২০ জোটভুক্ত দেশগুলোর। ক্ষয়ক্ষতি তো অনেক দূরের বিষয়।
এমন বাস্তবতায় কোভিড-১৯ খুব বাজেভাবে আঘাত হানল আমাদের ওপর। এটি একই সঙ্গে জলবায়ু, স্বাস্থ্য ও প্রকৃতির ত্রিমুখী বিপর্যয় নিয়ে এলো।
এই রূঢ়ভাবে হুঁশ ফেরার মধ্য দিয়ে অবশেষে বিশ্ব আমার সতর্কবার্তায় (জলবায়ু সংকট জরুরি অবস্থা) কান দিল। এ থেকে পরিত্রাণের যেকোনো পথ হতে হবে পরিবেশবান্ধব, প্রকৃতিভিত্তিক ও জলবায়ু সহিষ্ণু।
সিভিএফ সভাপতি হিসেবে আমার প্রথম কাজ ছিল জলবায়ু পরিবর্তনকে ‘গ্রহের জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করা এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে সবাইকে যুদ্ধাবস্থার প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানানো।
২০২০ সালের শরৎ নাগাদ আমি খুব কমসংখ্যক এনডিসি এবং কপ২৬-এর শর্ত পূরণ হতে দেখেছি। এমন পরিস্থিতিতে আমি সিভিএফ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে ‘মিডনাইট সারভাইভাল ডেডলাইন ফর দ্য দ্য ক্লাইমেট’ নামের উদ্যোগ ঘোষণা করেছি। প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক নেতার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছি, ‘নেতৃত্ব প্রদর্শনে ব্যর্থ হবেন না, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বর্ধিত এনডিসি ঘোষণা করুন।’ এটি ছিল কার্যত আমাদের (সিভিএফ) বেঁচে থাকার সময়সীমা।
আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৬০ দেশের সরকার ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে হালনাগাদ করা এনডিসি ঘোষণা করে।
যুক্তরাজ্যের এনডিসি আপডেট ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যই প্রথম তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখা এবং ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনায় সম্মত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্যারিস চুক্তিতে ফিরে আসাও ছিল প্রেরণাদায়ক। তবে যারা সিভিএফের ‘মিডনাইট ডেডলাইন’ পূরণে ব্যর্থ, তাদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, কোপ২৬-এর আগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এনডিসি জমা দিন।
সিভিএফের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বার্বাডোজ, কোস্টারিকা ও মালদ্বীপ ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটার কাছাকাছি আনার অঙ্গীকার করে। সর্বাধিক জনসংখ্যার সিভিএফ সদস্য বাংলাদেশ মিথেন নির্গমণ কমাতে প্যারিস সম্মেলন অনুসারে অন্তর্বর্তী এনডিসি আপডেট জমা দেয়।
বাংলাদেশ ও সিভিএফের জন্য টিকে থাকার প্রধানতম অগ্রাধিকার জলবায়ু অভিযোজন ও জলবায়ু অর্থায়ন।
সত্যি বলতে, জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলায় আমার দর্শন হলো কাণ্ডজ্ঞানের ব্যবহার। সেটি হলো নিজেকে সাহায্য করা এবং কারও উদ্ধারের আশায় বসে না থাকা। কারণ নিষ্ক্রিয়তার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের কাউকে ছাড় দেবে না।
২০২০ সালে ক্যাটাগরি-৫ ঘূর্ণিঝড় আম্ফান নিদারুণভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের ওপর আঘাত করে। সে সময় আমার দেশ পাঁচ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে ২৪ লাখ মানুষ ও ৫ লাখ গবাদি পশুকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে সক্ষমতার প্রমাণ দেখায়।
একই বছর মহামারির মধ্যেই আকস্মিক বন্যায় দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা তলিয়ে যায়। এই দুই দুর্যোগে আমাদের জিডিপির প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দুর্যোগের প্রস্তুতি থাকায় লাখো জীবন রক্ষা পেয়েছে।
জলবায়ু প্রকল্পগুলোতে নিজস্ব অর্থায়নের কৌশল শিখেছে বাংলাদেশ। আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ উপকূল এলাকাগুলোতে প্রায় ৮০০ জলবায়ু অভিযোজন ও সহিষ্ণুতা সংক্রান্ত প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিতে আমার সরকার ৪৫ কোটি ডলারের বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। বর্তমানে আমরা জলবায়ু অভিযোজন ও সহিষ্ণুতা অর্জনে বছরে গড়ে জিডিপির ২.৫ শতাংশ তথা পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছি।
সমুদ্র উপকূলে ১৬.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ, ১২ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং দুই লাখ হেক্টর জমিতে উপকূলীয় বৃক্ষরোপণ করেছি আমরা। উপকূলের দুর্গত মানুষের কথা ভেবে আমাদের বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিভিত্তিক কিছু সমাধান খুঁজে বের করেছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে লবণাক্ততা এবং খরাসহিষ্ণু ফসল উৎপাদন, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জলাধার, পুকুর-বালু-ফিল্টার, ভাসমান কৃষি প্রযুক্তি ও ভ্রাম্যমাণ পানি শোধনাগার।
জলবায়ু সহিষ্ণুতা নিয়ে আমাদের অর্জনে অনুপ্রাণিত হয়ে বান কি-মুন, ক্রিস্টালিনা জর্জিভা ও বিল গেটসের নেতৃত্বাধীন গ্লোবাল সেন্টার ফর অ্যাডাপটেশন (জিসিএ) আমাকে ঢাকায় জিসিএর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কেন্দ্র স্থাপনে উৎসাহ জুগিয়েছেন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রটি সিভিএফের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব জোরদারের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্য অভিযোজন তৎপরতাকে ত্বরান্বিত করতে কাজ করছে।
বাংলাদেশে আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সমৃদ্ধি অর্জন করছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর সময় ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি দশক ২০৩০’ পরিকল্পনা নিয়ে আমি সিভিএফ দেশগুলোকে ‘জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার’ শুরুর আহ্বান জানিয়েছি। আমরা এরই মধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী ১ কোটি ১৫ লাখ গাছ লাগিয়েছি। উল্লিখিত পদক্ষেগুলো আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি ধরে রাখতে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ কৌশলগত ও কম কার্বন নিঃসরণ উপযোগী বিনিয়োগ।
তবে সিভিএফ নিজে থেকে এতটুকু পর্যন্ত করতে পারে। অভিযোজনেরও একটা সীমা আছে।
সিভিএফ-কপের মধ্যে জোর ঐক্য গড়ে তোলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নভেম্বরের বৈঠক অনুযায়ী আমরা ঢাকা-গ্লাসগো-সিভিএফ-কপ২৬ ঘোষণা চাই।
জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে আমরা কপ২৬-এর আগেই জি২০ দেশগুলোর কাছে উচ্চাভিলাষী এনডিসি চাই।
আমরা জলবায়ু অর্থায়নকে শুধু কম-কার্বন অর্থনীতি বিনির্মাণে নিবেদিত দেখতে চাই না। আমরা চাই এ অর্থ প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনে ব্যয় হোক এবং সে তহবিলের অর্থের ৫০ শতাংশ ব্যয় হোক জলবায়ু সহিষ্ণুতা অর্জনে।
আন্তঃদেশীয় জলবায়ু সহযোগিতা এবং আমাদের ব্যাপক ক্ষতি ও জলবায়ু বৈষম্য সমাধানে আমরা আন্তর্জাতিক কার্বন বাজারগুলো চালু দেখতে চাই।
ঐক্যবদ্ধ না হলে প্রকৃতির সঙ্গে এই লড়াইয়ে আমরা হেরে যাব। যে সহায়ক ব্যবস্থা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, তা আমরা সচেতনভাবে ধ্বংস করছি। গ্রেটা থুনবার্গ বা বাংলাদেশ কোস্টাল ইয়ুথ অ্যাকশন হাবের জন্য আমরা কোন গ্রহ রেখে যাচ্ছি? কোপ২৬-এ আমরা তাদের ব্যর্থ হতে দিতে পারি না।
লেখক: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
লেখাটি দ্য ডিপ্লোম্যাট সাময়িকীর এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশ হয়েছে