সারা দেশে সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করছে সরকার।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবার সকালে তার সরকারি বাসভবন থেকে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান।
শনিবার সন্ধ্যার মধ্যে লকডাউন নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিস্তারিত তথ্য জানাবে জানিয়ে কাদের বলেন, ‘শিল্প কলকারখানা শর্তসাপেক্ষ চালু থাকতে পারে।’
করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং মাস্ক পরা জরুরি কর্তব্য বলে মনে করে সেগুলো পালন করার আহবান জানান তিনি।
কাদের বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকার ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। কিন্তু এখনো অনেকেই মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধির প্রতি অনিহা দেখাচ্ছে, যা প্রকারান্তরে ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে আসতে পারে।’
নিজেদের সুরক্ষায় সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্কতা মেনে চলারও আহ্বান জানান কাদের।
ওবায়দুল কাদেরের পাশাপাশি লকডাউন দেয়ার কথা জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
তিনি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘দ্রুত বেড়ে যাওয়া করোনার সংক্রমণ রোধ করার স্বার্থে সরকার দু-তিন দিনের মধ্যেই সারাদেশে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে এক সপ্তাহের জন্য।
‘লকডাউন চলাকালে শুধু জরুরি সেবা দেয়, সে ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকবে।’
এসবের পাশাপাশি আরও কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা থাকার কথা জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আর শিল্প-কলকারখানা খোলা থাকবে। যাতে করে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং বিভিন্ন শিফটিং এর মাধ্যমে তারা কলকারখানায় কাজ করতে পারেন।’
ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের করোনা মহামারিতে জনগণের পাশে না দাঁড়িয়ে ঘরে বসে মিডিয়ায় ঝড় তোলা আর সরকারের অন্ধ সমালোচনা ও মিথ্যাচার করাকে বিএনপির সফলতা হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘একবার লকডাউন নিয়ে অপপ্রচার, আবার করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে মিথ্যাচার, কখনও সরকারের ব্যর্থতা খোঁজা বিএনপির রোজনামচা হয়ে গেছে। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হয়েও দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ন্যূনতম মূল্যবোধ তারা হারিয়ে ফেলেছে।’
জনগণের সম্পদ বিনষ্ট আর নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে বিএনপি এবং তার সহযোগীরা যে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে তার জন্য বিএনপিকেই জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন কাদের।
গণপরিবহনের মালিকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে সড়কমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্যোগের মধ্যে জনগণের দুর্ভোগ বাড়াবেন না। কথা দিয়ে কথা না রাখলে আপনাদের ভালো হবে না।’
রমজান এলেই এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়, যা শাস্তি যোগ্য অপরাধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অহেতুক মূল্যবৃদ্ধি ও মজুদদারিতা নিয়ন্ত্রণে সরকার সতর্ক রয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে।’
বাজার অস্থির করার যেকোনো অপপ্রয়াস সরকার মেনে নেবে না, কোনো ধরনের সিন্ডিকেটের কাছে সরকার বাজার ব্যবস্থাকে জিম্মি হতে দেবে না বলেও হুঁশিয়ার করে দেন ওবায়দুল কাদের।
শনাক্তে রেকর্ড
গত কিছুদিন ধরেই দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। প্রতিদিনই শনাক্ত রোগী বাড়ছে রেকর্ড পরিমাণ। গত সাত মাস পরে আবারও করোনা শনাক্ত হয় রেকর্ড পরিমাণ। কয়েকদিন থেকে শনাক্ত ছাড়িয়ে গেছে পাঁচ হাজারের ঘর। এরপর উঠেছে ছয় হাজারের ঘরে।
দেশে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ৬ হাজার ৮৩০ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এ সময়ে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হয় ৫০ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুক্রবার পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশে এই নিয়ে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৬ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৪ জনের শরীরে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৯ হাজার ১৫৫ জনের।
গত এক দিনে দেশের ২২৬টি ল্যাবে ২৯ হাজার ৩২৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ২৮। সংক্রমণ বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
অর্থাৎ দেশে শকান্তের হার যেমন গত কয়েকদিনে বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে মৃত্যুর হারও। এমন অবস্থায় গত ২৯ মার্চ সরকার বেশ কিছু বিষয়ে বিধিনিষেধ দিয়ে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করে।
সে সময় অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী সারা দেশে একবারে লকডাউন দেয়া হবে না এমন কথা জানিয়েছিলেন।
যা আছে নির্দেশনায়
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ২৯ মার্চে দেয়া প্রজ্ঞাপনের ১৮ দফা নির্দেশনা অবিলম্বে সারা দেশে কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ সিদ্ধান্ত পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলেও জানানো হয়।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, করোনার উচ্চ সংক্রমণ থাকা এলাকায় সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়াও সীমিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ অন্যান্য জনসমাগম।
কক্সবাজারে করোনাভাইরাসের মধ্যেই ছিল পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। ফাইল ছবিবিয়ে-জন্মদিনসহ যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হবে বলেও জানানো হয়েছে এতে।
নির্দেশনায় বলা হয়, মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্রে জনসমাগম সীমিত করতে হবে। এ ছাড়াও সব ধরনের মেলা আয়োজনও নিরুৎসাহ দিতে হবে।
নির্দেশনায় গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ধারণক্ষমতার ৫০ ভাগের বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংক্রমিত এলাকাতে আন্তজেলা যান চলাচল সীমিত ও প্রয়োজনে বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিন পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক বা নিজ খরচে হোটেলে কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। এ ছাড়াও ওষুধের দোকানে মানতে বলা হয়েছে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাস্ক পরাসহ যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
শপিং মলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। অপ্রয়োজনে ঘোরাফেরা বা আড্ডা দেয়া যাবে না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাত ১০টার পর বাইরে বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছে।
ঘরের বাইরে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, এটা নিশ্চিত করা না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
করোনায় আক্রান্ত ও করোনা লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশন নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদেরও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা ৫০ ভাগ জনবল দিয়ে পরিচালনা করতে বলা হয়েছে। ৫৫ বছর বয়সের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘর থেকে কাজ করার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়াও সভা-সেমিনার, প্রশিক্ষণ, কর্মশালা যথাসম্ভব অনলাইনে আয়োজনের তাগিদ দেয়া হয়েছে এতে। স্বশরীরে উপস্থিত হতে হয় এমন যেকোনো ধরনের গণপরীক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
হোটেল-রেস্তোরাঁয় ধারণক্ষমতার ৫০ ভাগের বেশি মানুষের প্রবেশ বন্ধ করতে বলা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ ও অবস্থানের সময় মাস্ক পরা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে।