সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলছে সিটি ও দূরপাল্লার বাস। বাসের ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও বাসে ওঠার লাইনে তা মোটেও নেই। মুখে মাস্ক থাকলেও সামাজিক দূরত্ব মানছে না কেউ।
সাধারণ মানুষ সচেতন না হওয়ায় কেউ তদারকিও করছে না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষকে বাধ্য করতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম চললেও গত কয়েক দিনে তা দেখা যায়নি।
এক মাস ধরে করোনার সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যু। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৬ হাজার ৪৬৯ জনের দেহে। এ সময় ভাইরাসটিতে মৃত্যু হয়েছে ৫৯ জনের।
সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গত সোমবার ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। যার একটি হলো গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং ধারণক্ষমতার ৫০ ভাগের বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। এই নির্দেশনার পর পরিবহন মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গণপরিবহনে ভাড়া বেড়েছে ৬০ শতাংশ।
সরকারি, বেসরকারি অফিস-আদালত সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলায় সড়কে নিয়মিত যাত্রীর সংখ্যা আগের মতোই রয়ে গেছে। কিন্তু সরকারি নির্দেশনায় বাসের অর্ধেক সিটে যাত্রী পরিবহনের বাধ্যবাধকতার কারণে সংকট দেখা দিয়েছে।
পরিবহন সংকটে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। দীর্ঘ সময় লাইন ধরে থেকেও তারা গাড়িতে উঠতে পারছেন না। রাজধানীর ভেতরে চলাচলকারী বাসগুলোতে ওঠার জন্য যাত্রীদের দীর্ঘলাইন নগরীর প্রায় প্রতিটি পয়েন্টে দেখা গেছে। একই চিত্র মহাখালীতে আন্তজেলা বাস টার্মিনালে।
বাসের ভেতরে নিয়ম মেনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করা হলেও বাসে ওঠার জন্য যাত্রীদের লাইনে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না কেউ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলছে, কোথাও লাইনে দাঁড়াতে হলে একজন থেকে অপরজনের দূরত্ব হবে কমপক্ষে ৩ ফুট।
মহাখালী বাস টার্মিনালের ঢাকা-ময়মনসিংহগামী এনা পরিবহনের কাউন্টারের সামনে শতাধিক মানুষের লাইন দেখা গেছে। টিকিট নেয়ার লাইনে গায়ে গা ঘেঁষে অপেক্ষা করছেন সাধারণ মানুষ।
টিকিটের লাইন কাউন্টারের সীমা ছাড়িয়ে মূল টার্মিনালের ভেতর পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। এনা কাউন্টারের দায়িত্বশীলরা বলছেন, লাইনে কে স্বাস্থ্যবিধি মানছে আর কে মানছে না তা দেখা তাদের দায়িত্ব নয়।
যাত্রীদের একজন শামসুল। লাইনে স্বাস্থ্যবিধি না মানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি লাইনে দাঁড়ানোর সময় কিছুটা ফাঁকা রেখেছিলাম। পেছন থেকে মানুষের ধাক্কায় সামনে চলে আসছি। এখন দূরত্বটা নিজেদেরই মেনটেইন করতে হবে। আমার একার চাওয়ায় এখানে কিচ্ছু হবে না। আমি মাস্ক পরে আছি। কোনো কিছু ধরছি না। নিজেকে সেফ রাখার চেষ্টা করছি।’
লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় যথাযথ দূরত্ব বজায় না রাখলে সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে জানান করোনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত সরকারের কারিগরি কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে হবে। ব্যাংক, এটিএম বুথ, সুপারশপ, বাস বা প্রয়োজনীয় কাজে কোথাও লাইনে দাঁড়াতে হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখত হবে।
দূরপাল্লার বাসে যাত্রীর চাপ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী নেয়ার নির্দেশনা বাস্তবায়নের পর যাত্রীদের চাপ বেড়েছে দূরপাল্লার যানবাহনে। ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী বহন করার কারণে কোনো কোনো পরিবহনের টিকিট পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে যাত্রীদের। বৃহস্পতিবার দুপুরে মহাখালী আন্তজেলা বাস টার্মিনাল ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে এনা পরিবহনের ৭০টি গাড়ি ঢাকা ছেড়ে গেছে। আর বাসের জন্য অপেক্ষায় লাইন ধরে থাকতে দেখা গেছে কয়েক শ যাত্রীকে।
এনা পরিবহনের তুলনায় অন্যান্য পরিবহনে যাত্রীর সংখ্যা কিছুটা কম থাকলেও যাত্রীর চাপ রয়েছে। তবে প্রতিটি পরিবহনেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক যাত্রী বহন ও অতিরিক্ত ৬০ ভাগ ভাড়া আদায় হচ্ছে।
হাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করে প্রত্যেক যাত্রীকে গাড়িতে উঠতে দিচ্ছেন বিভিন্ন পরিবহনের কর্মীরা। শাহজালাল পরিবহনের কর্মচারী রাজিব বলেন, ‘আমাদের গাড়িতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী ওঠানো হচ্ছে। দুই সিটে একজন করে আমরা টিকিট বিক্রি করছি।’
তবে সপ্তাহের শেষ দিন হওয়ায় যাত্রীর চাপ বেশি বলে জানান ‘এনা পরিবহন’-এর আরেক কর্মী অলি। তিনি বলেন, ‘প্রতি বৃহস্পতিবারেই আমাদের চাপ বাড়ে। আজকে যাত্রীর সংখ্যা একটু বেশি।’
গতকাল থেকে যাত্রীর চাপ বেড়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা-কিশোরগঞ্জ সড়কে চলাচলকারী ‘অনন্যা পরিবহন’-এর কাউন্টার মাস্টার শামীম হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের যাত্রী খুব একটা বাড়েনি। কিন্তু অর্ধেক যাত্রী বহন করার কারণে চাপ বেড়েছে। গতকালকেও ছিল। তবে আজকে বৃহস্পতিবার হওয়ায় যাত্রীর সংখ্যা একটু বেশি।’
যাত্রী একই, বাসে জায়গা অর্ধেক
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী গত বুধবার থেকে সব বাস অর্ধেক সিটে যাত্রী নিয়ে চলাচল শুরু করেছে। তবে অফিস-আদালত খোলা থাকায় যাত্রী আগের মতোই। রাইড শেয়ারিংও বুধবার থেকে বন্ধ।
গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী নেয়ার নির্দেশনার দ্বিতীয় দিনে দুর্ভোগে পড়ে রাজধানীর যাত্রীরা। অফিসগামী যাত্রীরা নির্ধারিত সময়ের আগে বাসা থেকে বের হয়েও বাসে উঠতে পারেননি। বাস না পেয়ে বুধ ও বৃহস্পতিবার খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ মানুষ।
এদিকে রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, বাড্ডা ইউলুপসহ কয়েকটি এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন মোটরসাইকেলের চালকেরা। সরকার রাইড শেয়ারিং বন্ধের যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানিয়েছেন মোটরসাইকেলের চালকেরা।