হেফাজতে ইসলামের হরতাল চলাচালে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে, তাকে ‘চলার পথের ভুল’ আখ্যা দিয়েছেন সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক।
হেফাজত নেতা বলেছেন, তাদের কোনো দায়িত্বশীল কেউ সাংবাদিকদের মারধর করেনি। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের ভুল বোঝাবোঝি ছিল।
রোববারের হরতালের সময় সহিংসতার প্রতিবাদে সংগঠনের নায়েবে আমির ও নারায়ণগঞ্জ শাখা আমিরের পদ ছাড়ার ঘোষণা দেয়া আবদুল আউয়ালকে ফেরাতে রাজি করতে বুধবার এই জেলায় যান মামুনুল হক।
এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে বের হয়ে এসে তিনি হরতালে তাদের কর্মীদের গণমাধ্যমের প্রতি মারমুখো আচরণ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন।
হরতালে সহিংসতার দায় অস্বীকার করলেও সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনাটি কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন হেফাজত নেতা।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে মামুনুল বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম গণমাধ্যম কর্মীদের সম্মান করে। তবে হেফাজতের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে অথবা চলাচলের পথে ভুল হতে পারে। কিন্তু হেফাজতের কোনো দায়িত্বশীল নেতা সাংবাদিকদের মারধর করেনি।’
রোববারের হরতালে তাণ্ডবের কারণে হেফাজতের নায়েবে আমিরের পদ ছেড়ে দেয়া নেতা আবদুল আউয়ালের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন মামুনুল হক
যা হয়েছে রোববার দিনভর
হেফাজতের হরতালে চলাকালে রোববার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সাইনবোর্ড মোড় থেকে শিমরাইল মোড় পর্যন্ত সংবাদ সংগ্রহের কাজে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অন্তত ২০ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়। ছবি নিতে গেলে বা পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে রাস্তা পারাপারের সময় একের পর এক হামলার শিকার হয়েছেন তারা।
দৈনিক সংবাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি সৌরভ হোসাইন সিয়ামকে হয়রানির ঘটনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে। তার ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে ‘কলমা’ পাঠ করানোর অভিযোগ উঠেছে হেফাজত কর্মীদের বিরুদ্ধে।
মাদানীনগর মাদ্রাসা এলাকার রাস্তা রোববার দুপুরে অবরোধ করে সেখানে গাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় হরতাল সমর্থকেরা। সিয়াম সেই ঘটনার ছবি তোলার সময় হেফাজত কর্মীদের রোষানলে পড়েন। নিজের নাম প্রথমে সৌরভ বলাতে তাকে হিন্দু মনে করা হয়। বেধড়ক পেটানো হয় তাকে। এরপর তার ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত হতে পড়ানো হয় কলমা।
সৌরভ ফেসবুকে লেখেন, ‘চার কলমার দুই কলমা মুখস্থ বলতে হয়েছে। কয়টা সুরা মুখস্থ তা জানাতে হয়েছে।’
- আরও পড়ুন: নাম সৌরভ হওয়ায় ‘কলমা পাঠ’
শিরাইরাইলের কাছাকাছি জায়গায় হামলার শিকার হন নিউএইজের সাংবাদিক মোক্তাদির রশিদ রোমিও। তার সঙ্গে ছিলেন আরটিভি অনলাইনের একজন সাংবাদিক।
দুজন মহাসড়ক ধরে যাওয়ার পথে তাদের আটকায় কয়েকজন পিকেটার। পরিচয়পত্র দেখানোর পর তাদের ছাড়া হয়নি।
‘সঠিক নিউজ প্রচার হচ্ছে না’ দাবি করে রোমিও মাথায় বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। হেলমেট মাথায় থাকায় রোমিও খুব একটা আঘাত না পেলেও তার হেলমেটটি ভেঙে গেছে।
রোববারের হরতালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে মারমুখো ছিল হেফাজত কর্মীরা
রোমিও নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে আটকানোর পর তারা কোনো কথাই শুনছিল না। আইডি কার্ড দেখানোর পর তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। একজন আমার মাথায় আঘাত করে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। এরপর তাদেরই দুজন আমাকে সড়িয়ে নিয়ে আসে।’
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টিফোরের একটি গাড়ি সানারপাড় মোড়ের কাছে দাঁড়ানো ছিল। পিকেটাররা চালককের মারধর করে গাড়ির চাবি রেখে দেয়। এরপর গাড়িটি ভেঙে চুরমার করা হয়।
এক পর্যায়ে পিকেটারদেরই একজন গাড়িটি চালিয়ে রাস্তায় মাঝখানে নিয়ে আসে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য।
এ সময় নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় দুজন সাংবাদিক পিকেটারদের দিকে এগিয়ে যান। তাদের অনুরোধে গাড়িটি না জ্বালিয়ে চাবি ফিরিয়ে দেয় পিকেটাররা।
রোববারের হরতালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সাইনবোর্ড থেকে সিমরাইল পর্যন্ত অংশে দিনভর সংঘর্ষে জড়ায় হেফাজত কর্মীরা
সাইনবোর্ড এলাকায় ছবি তুলতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোরের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি বিল্লাল হোসাইন।
তার মোবাইল ফোনটি কেড়ে নিয়ে যায় পিকেটাররা। এরপর ওই এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে সড়ে আসেন তিনি।
গাড়িতে আগুনের ফুটেজ নেয়ার সময় মারধরের শিকার হয়েছেন জিটিভির ক্যামেরাপারসন মাসুদুর রহমান। মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পেয়েছেন তিনি।
মূল সড়ক ধরে সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড থেকে মৌচাকের দিকে যাওয়ার পথে বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক এম কে রায়হান ও বৈশাখী টেলিভিশনের আশিক মাহমুদ।
ধাওয়া করে তাদের মারধর করে হরতাল সমর্থক একদল যুবক। ছিনিয়ে নেয় মোবাইল ফোন।
আশিক মাহমুদ বলেন, “আমরা কোনো ছবি তুলছিলাম না, এমনকি ফোনও আমাদের হাতে ছিল না। পুলিশ পিকেটারদের হটিয়ে সামনে যাওয়ার পর আমাদের পেয়ে ‘এই ধর সাংবাদিক, পিঠা, জন্মের মাইর দে’ এসব বলে আমাদের বেধড়ক লাঠিসোটা দিয়ে মারধর করা হয়েছে। সারা শরীর জুড়ে মাইরের দাগ।