গত শুক্র ও রোববার হেফাজতে ইসলামের হরতালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডবের ঘটনায় করা মামলায় সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নাম না থাকার কী কারণ, সেটি ব্যাখ্যা করেছেন পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ।
তিনি বলেছেন, এজাহারে নাম নেই বলে তদন্তে কারও নাম আসবে না, এমন নয়।
গত সোম ও মঙ্গলবার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানসহ বিভিন্ন থানায় বেশ কিছু মামলা হয়েছে, আরও কিছু মামলার প্রস্তুতি চলছে।
হামলাকারী কারা ছিল, সেটি মোটামুটি স্পষ্ট থাকলেও মামলার আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতদের। বিএনপি বা অন্য দলের হরতালে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায় দলের শীর্ষ নেতাদের হুকুমের আসামি করা হলেও হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের এবার সেভাবে আসামি করা হয়নি।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেন, ‘আমরা কোনো কিছু কন্ট্রোভার্সাল করতে চাই না। আমাদের দেশে তো একটা কাজ করলে ১০ রকমের সমালোচনা শুরু হয়।
‘কারও নাম না থাকলে যে তদন্তে আসবে না, বিষয়টা তো এমন নয়।’
২৬ মার্চ সংঘর্ষের শুরু হয় বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুমার নামাজের পর থেকে। ফাইল ছবি
বুধবার হেফাজতের হামলায় গুরুতর আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে ঢাকা সিএমএইচে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও আইজিপি বেনজীর আহমেদ। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি।
আইজিপি বলেন, ‘যারা হামলা করেছে, তাদের মামলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদি নির্দেশদাতা থাকে, তারাও আসবে। আমরা তো নির্দেশদাতা কাউকে বাদ দিচ্ছি, এমন কথা বলছি না। আমরা বলছি, যারা অন স্পট হামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এবং তাদের তদন্তের সময় যারা যারা নির্দেশ দিয়েছে তারাও আসবে।’
কী উদ্দেশ্যে এমন হামলা হয়েছে বলে মনে করেন- এই প্রশ্নে পুলিশপ্রধান বলেন, ‘উদ্দেশ্য আমি যেটা মনে করি, এই হামলার মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছে।’
কোন প্রেক্ষিতে গুলি
পুলিশ কোন অবস্থায় গুলি চালিয়েছিল, সেটি ফুটে ওঠে আইজিপির বক্তব্যে।
তিনি বলেন, ‘প্রথমে বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও পরে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে...। ছাত্রদের ব্যবহার করা হয়। হাজার হাজার ছাত্র আমাদের হাটহাজারী থানাকে আক্রমণ করে। এই থানাকে আগেও একাধিকবার অ্যাটাক করেছিল। তারা ওখানে ডাকবাংলোতে অ্যাটাক করে। ভূমি অফিস জ্বালিয়ে দেয়। ভূমি অফিসের ল্যান্ড রেকর্ড একত্র করে জ্বালিয়ে দেয়। এতে ওই অঞ্চলের মানুষ বছরের পর বছর কষ্টে ভুগবে।’
ডাকবাংলোতে হামলা করে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পেটানো হয়েছে জানিয়ে আইজিপি বলেন, ‘পুলিশের একজন শিক্ষানবিস এএসপি থানাতে পোস্টিংয়ে ছিল। সে ডাকবাংলোয় অবস্থান করত। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে বেদমভাবে পেটানো হয়। তাকে মেরে ফেলার জন্য পেটানো হয়।’
বায়তুল মোকাররমে সংঘর্ষের সময় হেফাজতে ইসলাম ও সমমমনা ইসলামী দল পুড়িয়ে দেয় মোটারসাইকেল। ফাইল ছবি
‘আমাদের ডিএসবির একজন কনস্টেবলকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাকবাংলোর সামনে দায়িত্বে থাকা একজন সাবইন্সপেক্টরকে বেদম মারধর করে কিডন্যাপ করা হয়। সাবইন্সপেক্টর ও এএসপি প্রথমে চিটাগাং সিএমএইচে ভর্তি করি। এএসপি এখন সেখানে আইসিইউতে আছে। সাবইন্সপেক্টরের অবস্থার মারাত্মক অবনতি হওয়ায় আমরা তাকে ঢাকা সিএমএইচে এনে ভর্তি করাই। সেও আইসিইউতে আছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হরতালের দিনের নাশকতা নিয়ে পুলিশপ্রধান বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে বীভৎস, ধ্বংসাত্মক তাণ্ডব চালানো হয়েছে, প্রেসক্লাবও তাদের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। সাংবাদিকরা তাদের হাত থেকে ছাড় পায়নি।
‘ওইখানে আমাদের সদর ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর নূর আলম, তাকে বেদম পিটিয়েছে। খুন করার জন্য তারা বেদমভাবে প্রহার করেছে। তাকে আমরা কিছুটা পথ অ্যাম্বুলেন্সে, কিছুটা পথ হেলিকপ্টারে নিয়ে আসি। তাকে এখানে (ঢাকা সিএমএইচ) ভর্তি করি। তিনজনের মধ্যে এসআই মেহেদীর অবস্থা এখনও শঙ্কামুক্ত নয়।’
হেফাজতের কর্মীরা পুড়িয়ে দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন। ফাইল ছবি
যা করেছে হেফাজত
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের দিন গত ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় সরকার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ধর্মভিত্তিক দলের নেতা-কর্মীরা।
এই সংঘর্ষ চলাকালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মাদ্রাসার ছাত্ররা মিছিল নিয়ে হামলা করে স্থানীয় ডাকবাংলো, এসিল্যান্ড অফিস ও থানায়। তাদের ঠেকাতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন চারজন।
প্রায় একই সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়, আনসার ক্যাম্পে আগুনের পাশাপাশি হামলা হয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। সেখানে গুলিতে প্রাণ হারান একজন।
পরের দিন একই জেলায় সড়ক অবরোধ করে হেফাজত সমর্থকরা পুলিশের ওপর আবার হামলা চালালে গুলিতে নিহত হন আরও পাঁচজন।
রোববার হরতালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে তিন কিলোমিটার, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ আর বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালান হেফাজতের কর্মীরা।
হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা তাণ্ডব চালান চট্টগ্রামের হাটহাজারীতেও। ফাইল ছবি
মেঘনা পারের জেলাটিতে হেফাজত কর্মীদের আক্রমণ ছিল ভয়াবহ। সেখানে অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতিচিহ্ন ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভূমি অফিসে আগুন দেয়ার কারণে বহু নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
সহিংসতা মেনে নিতে না পেরে হেফাজতের একজন নায়েবে আমির সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেছেন।