শুক্রবার চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং রোববার সহিংস হরতালে হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা যে তাণ্ডব চালিয়েছেন তার নিন্দা জানিয়েছেন সংগঠনের সাবেক এক কেন্দ্রীয় নেতা।
প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফির নেতৃত্বাধীন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা রুহি মনে করেন, হেফাজতের বর্তমান কমিটির নেতারা গত কয়েক দিনে যা করেছেন তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
নিউজবাংলাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হেফাজতের নেতারা অকারণে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়ে তাদের প্রাণহানির কারণ হয়েছেন, কিন্তু নিজেরা ঠিকই নিরাপদে রয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ভারতের সরকারপ্রধান নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঘিরে দুই সপ্তাহ ধরেই সক্রিয় ছিল হেফাজত।
সফরের চার দিন আগে তারা সংবাদ সম্মেলন করে অঙ্গীকার করে রাজপথে কোনো কর্মসূচি থাকবে না। তবে এই ঘোষণা দেয়া হেফাজত নেতা মামুনুল হক ২৫ মার্চ বলেন, মোদি দেশে এলে সরকার পতনের ক্ষেত্র তৈরি করবেন তারা।
সফরের দিন বায়তুল মোকাররম এলাকায় সরকার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ধর্মভিত্তিক দলের নেতা-কর্মীরা। সাড়ে চার ঘণ্টার সংঘর্ষ চলাকালে সেদিন মাদ্রাসা থেকে মিছিল নিয়ে গিয়ে তাণ্ডব চালানো হয় চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরজুড়ে।
রোববার হেফাজতের হরতাল চলাচালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেয় মাদ্রাসাছাত্ররা
হাটহাজারীতে ডাকবাংলো, এসি ল্যান্ড অফিস ভাঙচুরের পর হামলা হয় থানায়। তখন পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হলে নিহত হন চারজন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন, মৎস্য অধিদপ্তর, আনসার ক্যাম্প ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে হামলায় পুলিশ গুলি চালালে নিহত হন একজন।
এর প্রতিক্রিয়ায় রোববারের হরতালে হেফাজতের কর্মীরা ছিল আরও সহিংস।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান ও হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে ত্রাস তৈরি করে।
বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, তার নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। সেখানে জেলা পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, সুর সম্রাট আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ছাড়াও তাণ্ডব চালানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির সবগুলো স্থাপনায়।
রোববারের হরতালে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতিচিহ্ন ভাঙচুর করে আগুন দেয়া হয়
হামলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধুর দুটি ম্যুরাল ভাঙচুরের পাশাপাশি দেয়া হয়েছে আগুন, ভাঙচুর চালানো হয়েছে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিফলকে, হামলা হয়েছে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার কার্যালয়ে, শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরেও ধরানো হয়েছে আগুন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল পর্যন্ত অংশে ভাঙচুর চালানো হয়েছে ৫০টির বেশি গাড়িতে, আগুন দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটিতে, ছাড় দেয়া হয়নি এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ও রোগীবাহী গাড়ি, গণমাধ্যমকর্মীদের দেখলেই এসেছে তেড়ে, এমনকি এক গণমাধ্যমকর্মীর নাম সৌরভ শুনে তাকে কালেমা বলতে বাধ্য করা হয়েছে।
সিরাজদিখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পেটানো হয়েছে দল বেঁধে, মসজিদে মাইকিং করে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে আজমিরীগঞ্জে, কিশোরগঞ্জে কোনো উসকানি ছাড়াই ভাঙচুর করা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়।
শুক্র ও রোববার হেফাজত সমর্থকরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা করে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে
এসব ঘটনায় প্রাণহানির প্রসঙ্গ টেনে সংগঠনের সাবেক নেতা রুহি বলেন, ‘যারা প্রাণ হারিয়েছেন তারা প্রত্যেকে তরুণ এবং বেশির ভাগই মাদ্রাসাছাত্র। তারা নেতাদের কথায় রাজপথে নেমেছেন। অথচ আন্দোলনের সময় হেফাজতের নেতারা গা ঢাকা দিয়েছিলেন। তারা আন্দোলনের সময় টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাই এই দায় নেতাদের।’
মাওলানা মঈনুদ্দীন রুহি বলেন, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে যে আন্দোলন হয়েছিল সেটির একটা লক্ষ্য ছিল। ইস্যুটি জাতীয় ছিল। সে জন্য হেফাজতের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু এবারের হেফাজতের আন্দোলন এই ধরনের কোনো তাৎপর্য বহন করে না। এটা একটি ব্যর্থ আন্দোলন।
তবে হেফাজতে ইসলামের বর্তমান কমিটির প্রচার সম্পাদক মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়েজী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন নিয়ে কে কী বলতেছেন সেটি আমরা দেখছি না। হেফাজত বিশৃঙ্খলার পক্ষে ছিল না। মোদিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশের আনার প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ করছিল। কিন্তু সরকার বায়তুল মোকাররমে হেফাজত কর্মীদের ওপর বিনা কারণে হামলা করে।
‘যার ফলে দেশজুড়ে হেফাজতের কর্মীরা আন্দোলন শুরু করেন। হেফাজত মনে করে, সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যদি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সুযোগ দিত, তাহলে এতগুলো মানুষের মৃত্যু হতো না। এসব মানুষের মৃত্যুর দায় সরকারকে নিতে হবে।’
নারায়ণগঞ্জে গাড়িতে আগুন দেয় হেফাজত কর্মীরা
আন্দোলন সফল কি না ব্যর্থ জানতে চাইলে জাকারিয়া নোমান ফয়েজী বলেন, ‘আমরা সফল এবং ব্যর্থ হওয়ার জন্য আন্দোলন করিনি। ইসলামী সংগঠন হিসেবে আমরা ইসলামবিরোধী একজন ব্যক্তির বাংলাদেশে আসা ঠেকাতে আন্দোলন করেছি।
‘আমরা প্রতিবাদ করেছি কীভাবে একজন ইসলামবিরোধী ব্যক্তি ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আসতে পারে সেটার। আমাদের আন্দোলনের শুরুটা ছিল শান্তিপূর্ণ কিন্তু পরিস্থিত সেটাকে বিশৃঙ্খল হতে সুযোগ করে দিয়েছে। এখন আমাদের ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেছি। এসব দাবি আদায়ে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাব।’