ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড মোড় থেকে শিমরাইল মোড় এলাকায় দিনভর তাণ্ডব চালিয়েছে হরতাল সমর্থকরা।
এই এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে একের পর এক, পোড়ানো হয়েছে বেশ কয়েকটি। হামলা থেকে বাদ যায়নি অ্যাম্বুলেন্সও। রোগী বহনকারী প্রাইভেট কারকেও ছাড় দেয়া হয়নি।
গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে আরও ব্যাপক। ‘সঠিক নিউজ প্রচার হচ্ছে না’ দাবি তুলে সাংবাদিক দেখলেই হামলে পড়েছে হেফাজতকর্মীরা।
রোববার ভোর থেকে সেখানে উপস্থিত ছিল পুলিশ, বিজিবি। হেলিকপ্টারে টহল দিয়েছে র্যাবও। কিন্তু হেফাজত সমর্থকদেরকে তারা মহাসড়ক থেকে সরাতে পারেনি।
সাইনবোর্ড মোড় থেকে শিমরাইল মোড় পর্যন্ত চার কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশেই বেশ কয়েকটি গলিপথ রয়েছে। মূলত চারটি স্পটে পিকেটিং করেছে হরতাল সমর্থকরা। সেগুলো হল- সাইনবোর্ড মোড়, সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড, মৌচার বাসস্ট্যান্ড ও শিমরাইল মোড়।
কোনো একদিকে পুলিশে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলেই ঢিল ছোড়া শুরু করে হেফাজতে ইসলামের হরতাল সমর্থকরা। গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে জবাব দেয় বিজিবি ও পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধাওয়া দিলে গলিতে ঢুকে হরতাল সমর্থকরা। এক গলি পেরিয়ে সামনের দিকে গেলেই আবার বিজিবি-পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়া শুরু হয়। পুলিশ ধাওয়া দিলে গলিতে লুকায় আর সামনে দিকে এগিয়ে গেলে মূল সড়কে পিকেটাররা অবস্থান নেয়। এই ‘খেলা’ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে।
এই প্রাইভেট কারটি রোগী বহন করছিল। কিন্তু হেফাজত কর্মীরা তাকে ছাড়েনি, উল্টো গাড়িটি ভাঙচুর করা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
হরতালের কারণে আটকে পড়া গ্রিনলাইন বাসের একজন স্টাফ মনিরুল ইসলাম। তিনি সকাল থেকেই এই এলাকায় ছিলেন। কারণ তাদের গাড়ির রাস্তায় আটকে ছিল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও হরতাল সমর্থকদের এই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়াকে ‘খেলা’ বলে অভিহিত করেছেন তিনি। বলেন, ‘পুলিশ দৌড়ানি দিলে হেফাজত গলিতে লুকায়, আর সামনে গেলে পুলিশরে ইট মারে। সারাটা দিন এই চলেছে।’
সারা দিনে এই এলাকায় গাড়ি পোড়ানো হয়েছে ছয়টি, ভাঙচুর করা হয়েছে ৫০টির বেশি। বাদ যায়নি অ্যাম্বুলেন্স ও রোগী বহনকারী গাড়ি।
পুলিশ ও বিজিবি মিলে পাঁচ শতাধিক গুলি ছুড়েছে। গুলিতে দুই জন আহতের তথ্য মিলেছে। তাদের একজনের নাম শাকিল, যাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। আরেকজনের নাম জানা যায়নি।
ভোর থেকেই মারমুখী মাদ্রাসা ছাত্ররা
ভোর ছয়টা থেকেই সড়কে অবস্থান নেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। আশেপাশের কয়েকটি মাদ্রাসা থেকে দল বেঁধে আসে ছাত্ররা। দুপুরের পরে যোগ দেয় তাদের সমর্থকরাও, যারা স্পষ্টতই মাদ্রাসার ছাত্র না।
সকাল সাতটা দিকে টায়ার ও গাছের গুঁড়ি জ্বালিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ফলে ঢাকা থেকে কোনো গাড়ি এই পথ দিয়ে কাঁচপুর ব্রিজ পার হয়ে চট্টগ্রাম বা অন্য কোনো গন্তব্যে যেতে পারেনি।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঘটনাস্থলে আসে বিজিবি।
সঙ্গে আসেন নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা বারিক। ১০টার দিকে সাইনবোর্ড মোড় থেকে শিরাইলের দিকে এগুতে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সকালেই লাঠিসোটা নিয়ে আশেপাশের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে এসে সড়কে অবস্থান নেয় হেফাজত কর্মীরা। ছবি: নিউজবাংলা
সবার সামনে থেকে এগিয়ে চলা শুরু করে বিজিবির একটি দল, পেছনে পুলিশ। সঙ্গে বিজিবি ও পুলিশের বিশেষায়িত গাড়ি। তারা কিছুদূর এগিয়ে আসলেই ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করে হেফাজতের নেতাকর্মীরা।
তাদের সড়িয়ে দিতে দিনে প্রথমবারে মতো গুলি ছুঁড়ে বিজিবি। এতে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে হেফাজত কর্মীরা।
সড়কে ফেলে রাখা জ্বলন্ত টায়ার ও নানা প্রতিবন্ধকতা সড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা। সঙ্গে সমানতালে চলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া।
আটকে থাকা গাড়ি আগাতে শুরু করতেই ভাঙচুর-আগুন
সাইনবোর্ড মোড় থেকে সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়ক থেকে হরতাল সমর্থকদের সড়িয়ে দেয়ার পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী গাড়িগুলোকে সামনে চলার নির্দেশ দেন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম। গাড়িগুলো সকাল থেকেই সাইনবোর্ড মোড়ে আটকে ছিল।
পুলিশের নির্দেশনা পেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে শুরু করে গাড়িগুলো। হরতালের মধ্যেও সড়কে যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হচ্ছে দেখে আবার আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে হেফাজতের কর্মীরা।
এক সড়কেই ছয়টি গাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে, ভাঙচুর করা হয়েছে ৫০টিরও বেশি। ছবি: নিউজবাংলা
সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে আসা গাড়িগুলো ভাঙচুর শুরু করে। অন্তত ১০টি গাড়ি ভাঙা হয় এ সময়। আবার শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া।
বিজিবি-পুলিশের ধাওয়া খেয়ে হেফাজত নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয় মৌচাক বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের উপর ইট পাটকেল ছোড়ে হেফাজতের সমর্থকরা। বিজিবিও পাল্টা গুলি করে।
বেলা ১২টার দিকে কয়েক দফা পিকেটারদের ধাওয়া দিয়ে মূল সড়ক কিছুটা পরিষ্কার করে বিজিবি ও পুলিশ। সাইনবোর্ড ও সানারপাড় বাসস্ট্যান্ডের মধ্যে আটকে পড়া গাড়িগুলো আবার সামনে যেতে বলে পুলিশ।
এবারের ধাপে সানারপাড় থেকে মৌচাক বাসস্ট্যান্ড পাড় হয়ে কিছু গাড়ি শিমরাইলের দিকে যেতে পারলেও হরতাল সমর্থকদের হামলার মুখে বাকি সব গাড়ি আটকে পড়ে। এবার পাঁচটি গাড়িতে আগুন দেয় পিকেটাররা। তিনটি ট্রাক, একটি বাস ও একটি মাইক্রোবাস জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
দুপুরের পরে যে পরিস্থিতি
দুপুরের পর থেকে চিত্রটা ভিন্ন হতে থাকে। সকাল থেকে রাস্তায় বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেশি দেখা গেলেও দুপুরের পর থেকে কমতে থাকে। তবে বাড়তে থাকে হরতাল সমর্থনে পিকেটারদের সংখ্যা।
দিনভর পুলিশের বিপুল উপস্থিতিতেও হেফাজত কর্মীরা সড়কে অবস্থান ছাড়েনি। ছবি: নিউজবাংলা
এবার দৃশ্যপটে সামনে আসে পুলিশ। তবে তাদের কর্ম তৎপরতাও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারেনি। ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনা বেড়েছে।
দুপুরের পর মাদ্রাসা ছাত্রদের পোশাক পরা ছাড়াও সাধারণ পোশাকে অনেককেই দেখা গেছে। আর এই সময়েই পুলিশ ও বিজিবির ওপর হামলা এবং সাংবাদিকদের দেখে দেখে মারধরের ঘটনা বেশি ঘটেছে।
সাংবাদিক পেলেই হামলা
সংবাদ সংগ্রহের কাজে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অন্তত ২০ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন। ছবি নিতে গেলে বা পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে রাস্তা পারাপারের সময় একের পর এক হামলার শিকার হয়েছেন তারা।
শিরাইরাইলের কাছাকাছি জায়গায় হামলার শিকার হন নিউএইজের সাংবাদিক মোক্তাদির রশিদ রোমিও। তার সঙ্গে ছিলেন আরটিভি অনলাইনের একজন সাংবাদিক।
দুজন মহাসড়ক ধরে যাওয়ার পথে তাদের আটকায় কয়েকজন পিকেটার। পরিচয়পত্র দেখানোর পর তাদের ছাড়া হয়নি।
‘সঠিক নিউজ প্রচার হচ্ছে না’ দাবি করে রোমিও মাথায় বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। হেলমেট মাথায় থাকায় রোমিও খুব একটা আঘাত না পেলেও তার হেলমেটটি ভেঙে গেছে।
নিউজ টোয়েন্টিফোরের গাড়িটি ভেঙে আগুন দিতে চেয়েছিল হেফাজত কর্মীরা। পরে নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকদের অনুরোধে তারা ক্ষান্ত হয়। ছবি: নিউজবাংলা
রোমিও নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে আটকানোর পর তারা কোনো কথাই শুনছিল না। আইডি কার্ড দেখানোর পর তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। একজন আমার মাথায় আঘাত করে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। এরপর তাদেরই দুজন আমাকে সড়িয়ে নিয়ে আসে।’
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টিফোরের একটি গাড়ি সানারপাড় মোড়ের কাছে দাঁড়ানো ছিল। পিকেটাররা চালককের মারধর করে গাড়ির চাবি রেখে দেয়। এরপর গাড়িটি ভেঙে চুরমার করা হয়।
বিজিবি কর্মীরা গুলি করেও দমাতে পারেনি হেফাজত কর্মীদের। তারা এলাকা ছাড়লেও নিরাপত্তা কর্মীরা চলে গেলেই আবার ফিরে আসে। ছবি: নিউজবাংলা
এক পর্যায়ে পিকেটারদেরই একজন গাড়িটি চালিয়ে রাস্তায় মাঝখানে নিয়ে আসে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য।
এ সময় নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় দুজন সাংবাদিক পিকেটারদের দিকে এগিয়ে যান। তাদের অনুরোধে গাড়িটি না জ্বালিয়ে চাবি ফিরিয়ে দেয় পিকেটাররা।
সাইনবোর্ড এলাকায় ছবি তুলতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোরের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি বিল্লাল হোসাইন।
তার মোবাইল ফোনটি কেড়ে নিয়ে যায় পিকেটাররা। এরপর ওই এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে সড়ে আসেন তিনি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ছবি: নিউজবাংলা
গাড়িতে আগুনের ফুটেজ নেয়ার সময় মারধরের শিকার হয়েছেন জিটিভির ক্যামেরাপারসন মাসুদুর রহমান। মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পেয়েছেন তিনি।
মূল সড়ক ধরে সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড থেকে মৌচাকের দিকে যাওয়ার পথে বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক এম কে রায়হান ও বৈশাখী টেলিভিশনের আশিক মাহমুদ।
ধাওয়া করে তাদের মারধর করে হরতাল সমর্থক একদল যুবক। ছিনিয়ে নেয় মোবাইল ফোন।
আশিক মাহমুদ বলেন, “আমরা কোনো ছবি তুলছিলাম না, এমনকি ফোনও আমাদের হাতে ছিল না। পুলিশ পিকেটারদের হটিয়ে সামনে যাওয়ার পর আমাদের পেয়ে ‘এই ধর সাংবাদিক, পিঠা, জন্মের মাইর দে’ এসব বলে আমাদের বেধড়ক লাঠিসোটা দিয়ে মারধর করা হয়েছে। সারা শরীর জুড়ে মাইরের দাগ।”