বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর বিরোধীদের সঙ্গে সংঘর্ষে শুক্রবার জুমার পর রণক্ষেত্রে পরিণত হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম ও আশপাশের এলাকা।
যে কোনো ধরনের সংঘাত এড়াতে জুমার নামাজের আগে থেকেই বায়তুল মোকাররমের চারপাশসহ মতিঝিল ও গুলিস্থান এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
জুমার নামাজের সময় ঘনিয়ে এলে দলে দলে মুসল্লিরা বায়তুল মোকাররম মসজিদে জড়ো হতে থাকেন। তাদের মধ্যে মোদির সফর বিরোধী ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীরা ছিলেন। দুই পক্ষই মসজিদে নামাজ পড়েন।
নামাজের পর দুপুর পৌনে ২টার দিকে মসজিদের ভেতরেই জুতা হাতে নিয়ে মোদির সফর বিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করেন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা। এ সময় ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীরা তাদের বাধা দিলে তাদের ধাওয়া দেন তারা। এক পর্যায়ে সরকার সমর্থকরা মসজিদ থেকে বের হয়ে আসেন।
মিনিট দশেক পরে সরকার সমর্থকরা মিছিল করতে থাকেন মসজিদের উত্তর গেটের সামনের সড়কে। এ সময় তাদের ওপর ইট-পাটকেল ছুড়ে মারা হয় মসজিদের ভেতর থেকে।
ইট ছুড়ে মারা এক তরুণেকে ধরে নিয়ে আসার সময় মোদির সফর বিরোধীরা সরকার সমর্থকদের ওপর হামলা করে। পরে সরকার সমর্থকরা সুসংগঠিত হয়ে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া দিলে তারা মসজিদের ভেতরে অবস্থান নেন। আর সরকার সমর্থকরা মসজিদের উত্তর গেটে অবস্থান নিয়ে ভেতরে থাকা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে।
তখন বাইরে থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ার শেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এসে আরও উত্তপ্ত হতে থাকে।
এরপর বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ মসজিদ ও মার্কেটের ছাদে অবস্থান নেন। সেখান থেকে তারা পুলিশ এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছুড়তে থাকেন।
এর মাঝেই বিক্ষোভকারীদের একাংশ মসজিদের বাইরে এসে উত্তর গেটে দুটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর মধ্যে একটি মোটরসাইকেল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সদস্য মো. সেলিমের নিশ্চিত হয়েছে নিউজবাংলা।
এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে পুলিশ জলকামান থেকে গরম পানি ছিটিয়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে।
এ সময় বিক্ষোভকারীরা মসজিদের উত্তর গেট প্রাঙ্গণ ছেড়ে ভেতরে ও ছাদে অবস্থান নেন। সেখান থেকে তারা পুলিশ এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছুড়তে থাকেন।
উত্তর গেটে এ ভাবে প্রায় দুই ঘণ্টা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পুলিশ এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীদের।
ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীরা বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সংঘবদ্ধ হয়ে মসজিদের দক্ষিণ গেটে অবস্থান নিলে পরিস্থিতি আরও উত্তাল হয়। তখন তারা জামায়াত-শিবির বিরোধী স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া দেন। এক পর্যায়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে।
এক পর্যায়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ার শেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীরা বিছিন্ন হয়ে যান। সেই সুযোগে বিক্ষুব্ধ মুসল্লিরা মসজিদের দক্ষিণ গেটে থাকা চারটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন।
বিকেল সোয়া ৪টার দিকে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর বায়তুল মোকাররম এলাকা অতিক্রম করার কথা ছিল। সে কথা বলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীদের সেখান থেকে সরিয়ে দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যারা।
এরপর মসজিদের ভেতরে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এর প্রায় আধা ঘণ্টা পর যানবাহন চলাচলের জন্য রাস্তা খুলে দেয়া হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। দুই গেটের সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন আহত হন।
দক্ষিণ গেটে মসজিদের ভেতরে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের একাংশ অভিযোগ করে নিউজবাংলাকে জানান, তারা শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ পড়তে এসে হামলার শিকার হয়েছেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগকর্মীরা এই হামলা করেছে। এতে অসংখ্য মুসল্লি আহত ও চারজন নিহত হয়েছেন।
এ সময়ও তারা মোদি বিরোধী স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন। চারজন নিহত হওয়ার যে অভিযোগ তারা করেছেন তার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
উত্তর গেটে অবস্থান নেয়া বিক্ষোভকারীদের অপর অংশ নিউজবাংলাকে বলেন, তারা মোদি না যাওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে যাবেন না। কোনো সংঘাত চাননি বলেও দাবি করেন তারা।
তাদের একজন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্রতিবাদ করতে এসেছি। মারামারি করতে নয়। আমাদের উপর পরিকল্পিতভাবে হামলা হয়েছে। আমরা কাউকে আগে থেকে মারিনি।
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের মতিঝিল জোনের উপকমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বিকেল ৫টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছি। আপনারা তো বাকিটা দেখেছেন। আমরা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মসজিদ প্রাঙ্গণ ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেছি।’
সহিংসতার শঙ্কায় আগে থেকে আপনাদের প্রস্তুতি ছিল কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে। যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। আশা করি, আর কোনো বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হবে না।’