দীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণের ইতিহাস ছুড়ে ফেলে বিশ্বে নতুন এক মানচিত্রের ঘোষণা দিয়েছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষ। আজ ২৬ মার্চ সেই ঘোষণার ৫০তম বার্ষিকী। ১৯৭১ সালের এই দিনেই এক নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ।
১৯৪৭ এ দেশভাগের মধ্য দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছিল ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র। শুধু মুসলিম সংখ্যাধিক্য থাকায় তৎকালীন পূর্ব বাংলাকে জুড়ে দেয়া হয় ১২শ’ মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে। এরপর শুরু হয় শোষণের ইতিহাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির যে সংগ্রাম শুরু হয় তা পূর্ণতা পায় একাত্তরে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালের আজকের দিনেই বাংলাদেশ নামক নতুন এ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে নতুন মাত্রা দিয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীও। এই দুই বিশেষ ঘটনা বাঙালি জাতিকে দিয়েছে উদযাপনের নতুন মাত্রা। স্বাধীনতার ৫০ বছরের আরেকটি অর্জন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ।
মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা যোগ্যতা নির্ধারণের এই তিনটি সূচকের ২০১৮ ও ২০২১ সালের মূল্যায়নে মান অর্জন করায় এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) সম্প্রতি এ সুপারিশ করেছে।
বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের সুপারিশের এই ঘটনাকে বড় অর্জন হিসেবে আখ্যা দিয়ে মার্কিন পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামের উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল আছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামের উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের যে তুলনা দেয়া হয়েছে, তার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এই দেশগুলোও রপ্তানিভিত্তিক উন্নয়নের পথে হেঁটে আজ এত দূর।
আধুনিক ইতিহাসে দেখা গেছে, রপ্তানিমুখী উন্নয়নের বদৌলতে অতি নিম্ন আয়ের দেশও মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে পারে। বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সফল অর্থনীতি হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশ আখ্যা দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। এ প্রাপ্তি নিয়েই এবার জাতি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ২০২১ সালে স্বাধীনতা লাভের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছে। এই মহান উৎসব উদযাপনের লক্ষ্যে আমরা বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত এবং একটি মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, যাতে কেউ আমাদের দরিদ্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করে অবহেলা করতে না পারে।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। গত ১৭ মার্চ শুরু হয়েছে এ অনুষ্ঠান। বিদ্যমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে আয়োজিত এ সব অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি অতিথিরা অংশগ্রহণ করছেন।
১৭ মার্চের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ। এরপর ১৯ মার্চ শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, ২২ মার্চ নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি ও ২৪ মার্চ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন। শুক্রবারের অনুষ্ঠানে থাকছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতি মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহিদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হবে দিনের কর্মসূচি।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অতর্কিত হামলা চালালে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করলেও বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সব রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।
সেনা অভিযানে হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।