পরিচয় দিয়ে বেড়ান জাপান-বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার মহাসচিব হিসেবে। তবে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে যে সহমর্মিতাবোধ ও সাধারণের পাশে থাকার রীতি, কাজকর্ম তার বিপরীত।
নাম তার আমিনুল ইসলাম হান্নান। রাজধানীর দক্ষিণখানের আইনুসবাগ এলাকায় আইনবিরোধী নানা কাজকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এবার উঠেছে হত্যার অভিযোগ। আর ঘটনাটি ঘটেছে প্রকাশ্যে।
অস্ত্র ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে স্থানীয়দের নানা ধরনের অত্যাচারের অভিযোগ আছে হান্নান ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে। চাঁদা দিতে না চাইলে হামলা-হুমকি একেবারেই সাধারণ ঘটনা সেখানে।
এর মধ্যে বুধবার সকালে প্রকাশ্যে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় দুটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ ধরা পড়েছেন হান্নান। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ঘটনার পেছনেও রয়েছে চাঁদাবাজি।
নিহতের নাম আব্দুর রশীদ। গুলি লাগে তার মুখে এবং একাধিক গুলিতে মৃত্যু হয়।
বুধবার বেলা ১১টার দিকে দক্ষিণখানের আইনুসবাগ এলাকায় হান্নানের বাড়ির সামনে এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ রশিদকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় কেসি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে ডাক্তাররা মৃত ঘোষণা করেন।
দক্ষিণখানে হান্নানের শটগানে গুলিতে রক্তাক্ত হওয়ার পর আব্দুর রশীদকে উদ্ধার করছে স্থানীয়রা
রশিদকে গুলি করার পর কিছু লোকজন হান্নানের বাড়ির সামনে থাকা তার একটি জিপ গাড়ি আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। বাইরে থেকে হান্নানের বাড়িতে ইট-পাটকেলও ছুড়ে মারে তারা।
এই ঘটনায় হান্নান ছাড়াও দক্ষিণখান থানা আটক করেছে আরও অন্তত সাতজনকে। তাদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
দক্ষিণখানে একজনকে গুলি করে হত্যার পর স্থানীয়রা এই গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়
ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের (দক্ষিণখান) অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজুর রহমান রিয়েল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বালু ফেলাকে কেন্দ্র করে এক লাখ টাকা চেয়েছিলেন হান্নান। টাকা না দেয়ায় বালু চুরি হয়। আজকে বালু চুরির বিষয়ে কথা বলতে ঠিকাদার ও তার ভাই-চাচা এসেছিলেন। কথা বলার এক পর্যায়ে শটগান দিয়ে গুলি করেন হান্নান। এতে রশিদ নামে একজনের মৃত্যু হয়।’
যত অভিযোগ
হান্নান দক্ষিণখানের আইনুসবাগ এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ কায়েম করেছিল বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। প্রকাশ্যে গুলি করে রশিদকে হত্যার পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন তারা।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, হান্নানের বাবা চাঁদপুর থেকে ২০-২৫ বছর আগে দক্ষিণখানে আসেন। এরপর থেকে এখানেই আছেন। আইনুসবাগে করেছেন নিজেদের বাড়ি।
নিজেকে মানবাধিকার কর্মী পরিচয় দিলেও এলাকায় নানা ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে হান্নানের বিরুদ্ধে
৯০ দশকে জাপানে ছিলেন হান্নান। বিদেশ থেকে ফিরে টাকা দিয়ে কিছু মানুষকে নিজের করে নেন।
আইনুসবাগ এলাকায় বাড়ি করা অধিকাংশ মানুষ অন্য জায়গা থেকে এসেছেন। কিছু মানুষকে নিয়ে বাড়ির মালিকসহ ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রেখেছিলেন হান্নান ও তার লোকজন।
বাড়ির সীমানায় দোকান করার সময় ১০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিলেন হান্নান। কিন্তু সেই টাকা না দেয়ায় দোকান নির্মাণ বন্ধসহ কেটে দেয়া হয় তার গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ। তাড়িয়ে দেয়া হয় বাড়ির ভাড়াটিয়াদেরও।
হান্নানের এই নির্যাতনের শিকার তারই প্রতিবেশী মোজাম্মেল পাটোয়ারী। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১০ মাস আগে আমার বাড়ির সামনে দোকান করতে চেয়েছিলাম। তারে টাকা না দেয়ায় দোকান তো দূরের কথা, বাড়ির ভাড়াটিয়াদেরও থাকতে দেয়নি। গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের লাইন কেটে দিছে। এখনও ভাড়াটিয়া তুলতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘সবসময় সঙ্গে পিস্তল নিয়ে ঘুরতেন হান্নান। বিভিন্ন এমপি, মন্ত্রীর ছবি দেখিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতেন। যে কারণে এলাকার কেউ কিছু বলতে সাহস পেত না।’
মানবাধিকার কর্মী পরিচয় ছাড়াও সরকারি দলের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার জানান নানাভাবে দেন হান্নান
মোজাম্মেল বলেন, ‘বাড়িতে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বন্ধ করার অভিযোগ জানিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলাম। পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো জিডি করার কারণে হান্নান এসে আমাকে মারতে মারতে রাস্তায় এনে ফেলছেন।’
তবে দক্ষিণখান থানার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এতদিন লোকজন তেমন একটা অভিযোগ করেনি। এখন অনেকে কথা বলছে।
‘সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে ছবি রয়েছে হান্নানের। যেগুলো তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর ব্যবহার করতেন। আর এসব ছবি দেখিয়ে মানুষকে তার ক্ষমতার হাত কতদূর তা বুঝাতেন।’
আইনুসবাগ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য সাহারা খাতুনসহ বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তির ছবির সঙ্গে নিজের ছবি দিয়ে পোস্টার, ব্যানার, সাইনবোর্ড বানিয়ে পুরো এলাকায় প্রচার করতেন হান্নান। এজন্য লোকেরা তাকে সাইনবোর্ড হান্নান বলেও ডাকে।
বাড়ির সামনে প্রকাশ্যে খুন
পাশের একটি বাড়িতে বাউন্ডারির কাজে বালু ফেলাকে কেন্দ্র করে ঠিকাদারের কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন হান্নান। আর এই টাকা না দেয়ায়, ঠিকাদারের ফেলা বালু রাতের আধারে চুরি করে নিয়ে যায় হান্নানের লোকজন। মারধর করা হয় ঠিকাদারের লোকজনকে।
হান্নানের এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কথা বলতে থানা-পুলিশসহ লোকজন নিয়ে হান্নানের বাড়ির সামনে আসেন ঠিকাদার মাহমুদুল হাসান সুজনের চাচাত ভাই আব্দুর রশীদ। কথা বলার এক পর্যায়ে আব্দুল রশীদকে সামনে থেকে শটগান দিয়ে গুলি করেন হান্নান।
দুই যুগ আগে হান্নানের বাবা চাঁদপুর থেকে এসে দক্ষিণখানের আইনুসবাগে উঠেন। সেখানে এই বাড়ি করেন তারা
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন রশিদের চাচাতো ভাই সুজনসহ অন্তত ২০-২৫ জন ব্যক্তি, যাদের মধ্যে থানা-পুলিশের সদস্যরাও ছিলেন।
তাদের বর্ণনা অনুযায়ী, রশিদ তখন হান্নানের বাড়ির গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। কথা বলার এক পর্যায়ে হান্নান গেইটের ভেতরে চলে যান এবং শটগান নিয়ে গুলি ছোড়েন। প্রথম গুলিতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রশিদ। এরপর আরও একটি গুলি করা হয়।
সুজন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হান্নানের বাড়ির পেছনে একটি বাড়ির বাউন্ডারির কাছ চলছিল। ওই কাজের জন্য বালু আনা হয়। বালু ফেলার পর হান্নান তার লোকজন দিয়ে কাজে বাধা দেয়। আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে। ওখানে কাজ করতে হলে নাকি তাকে টাকা দিতেই হবে।
‘টাকা না দেয়ায় গতকাল রাতে আমাদের বালু চুরি করে নিয়ে যায়। আজকে সকালে আমার কাজিনসহ কয়েকজন ছেলেকে মারধর করে হান্নান ও তার লোকজন। এসব শুনে আমার চাচাতো ভাই রশিদ, চাচাসহ আমরা হান্নানের বাড়ির সামনে আসি।
‘আমরা এই বিষয়টা থানাকে জানিয়েছিলাম। পুলিশও আমাদের সঙ্গে ছিল। রশিদ, সোহেলসহ ৩-৪ জন সামনে যায় হান্নানের সঙ্গে কথা বলতে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে হান্নান ভেতরে গিয়ে তার শটগান দিয়ে গুলি করে।’