প্রায় ২১ বছর আগে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সমাবেশস্থলের পাশে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা রাখার ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ ও হত্যা ষড়যন্ত্র মামলায় ১৪ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। সেইসঙ্গে আসামিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন বিচারক।
২৩ মার্চ মঙ্গলবার ঢাকার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান এই রায় দেন।
- আরও পড়ুন: যার জন্য সেদিন প্রাণে বাঁচেন শেখ হাসিনা
রায়ে বিচারক বলেন, ‘মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ১২১/৩৪/১০৯ ধারার অপরাধজনক মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হলো। একটি ফায়ারিং স্কোয়াডে আসামিদের প্রকাশ্যে প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ প্রদান করা হলো।’
তবে ফায়ারিং স্কোয়াডে দণ্ড কার্যকর করা না গেলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশও দেন বিচারক।
‘নির্দেশ মোতাবেক তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে কর্তৃপক্ষের কোনো অসুবিধার কারণ থাকলে প্রচলিত নিয়মানুসারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হলো।’
এর আগে ১২টা ১৫ মিনিটে আসামিদের কাঠগড়ায় উপস্থিত করার সাত মিনিট পর রায় পড়া শুরু হয়। ১১ মার্চ রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের জন্য ২৩ মার্চ দিন রাখে ট্রাইব্যুনাল।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- আজিজুল হক ওরফে শাহনেওয়াজ, লোকমান, ইউসুফ ওরফে মোছহাব মোড়ল, মোছহাব হাসান ওরফে রাশু, শেখ মো. এনামুল হক, মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ, মাহমুদ আজহার ওরফে মামুনুর রশিদ, রাশেদুজ্জামান ওরফে শিমুল, তারেক, ওয়াদুদ শেখ ওরফে গাজী খান, আনিসুল ইসলাম, সারোয়ার হোসেন মিয়া, মাওলানা আমিরুল ইসলাম ওরফে জেন্নাত মুন্সী ও মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান।
আসামিদের মধ্যে আজিজুল হক, লোকমান, ইউসুফ, এনামুল হক ও মোছহাব হাসান পলাতক। আর মাওলানা আমিরুল ইসলাম ওরফে জেন্নাত মুন্সী ও মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান জামিনে রয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীতগত ২৮ ফেব্রুয়ারি তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক এএসপি আব্দুল কাহার আকন্দের সাক্ষ্যের মধ্য দিয়ে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়।
মামলায় চার্জশিটভূক্ত ৫০ সাক্ষীর মধ্যে ৩৪ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন৷ এরপর আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ১১ মার্চ রায়ের জন্য ২৩ মার্চ দিন রাখেন।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ কলেজের মাঠে ২০০০ সালের ২১ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশ থেকে ৭৬ কেজি ওজনের একটি বোমা উদ্ধার করা হয়। ওই মাঠেই পরদিন শেখ হাসিনার সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল।
এ ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক নূর হোসেন বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা করেন।
এরপর ২০০১ সালের ১৫ নভেম্বর সিআইডির সাবেক এএসপি আব্দুল কাহার আকন্দ মামলার অভিযোগপত্র দেন। এতে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের পাশাপাশি রাষ্ট্রদ্রোহ ও হত্যার ষড়যন্ত্র ধারাও যুক্ত করা হয়।
২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
এই ঘটনায় হওয়া হত্যাচেষ্টা মামলায় ২০১৭ সালের ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত-২ এর বিচারক মমতাজ বেগম ১০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টও আসামিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার প্রসঙ্গও আসে।
পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার জন্য ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিরা বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার মাধ্যমে তারা দেশকে ধ্বংস করাসহ চক্রান্তে মেতে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবর্তীতে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসলে ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্নভাবে তাকে ২০ বার হত্যা চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে ব্যর্থ হয়।
আসামিদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, মুফতি হান্নানের আদালতে দেয়া জবানবন্দি অনুযায়ী ২০০০ সালের জুলাই মাসে হুজির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বৈধ সরকারকে উৎখাত করার জন্য শেখ হানিাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন তারা। ওই বছরের ২০ জুলাই কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলে হেলিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ও ৪০ কেজি ওজনের দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। সমাবেশের আগে চায়ের দোকানে বদিউজ্জামান কর্তৃক পুঁতে রাখা বোমা পুলিশ উদ্ধার করে।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বারবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে হুজি। প্রথম ঘটনায় গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ২০ জুলাই, ২০০০, দ্বিতীয় ঘটনায় খুলনায় ৩০ ম, ২০০১, তৃতীয় ঘটনা সিলেটের ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০০১ এবং চতুর্থ ঘটনায় ঢাকায় ২১ আগস্ট, ২০০৪।
এই কারণে হুজি ও জেএমবিসহ ইসলামী জঙ্গিরা এই কারণে আসামিদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে উল্লেখিত ও ন্যাক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে বলে অত্র ট্রাইব্যুনাল মনে করে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামিদেরকে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হলো।