মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আমিরুল ইসলাম মোহম্মদপুরে ৯.৯ শতাংশ জমি মাত্র ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় কিনেছেন। এই জমি তিনি বিক্রি করেছেন ৮৭ হাজার ৫০০ টাকায়।
জমি কেনাবেচার এই অস্বাভাবিক হিসাব তিনি দেখিয়েছেন তার দুটি ভিন্ন অর্থবছরের আয়কর বিবরণীতে।
আমিরুল ইসলাম বছর জুড়ে আয় করেছেন ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪০ টাকা। অথচ তিনি বছরে ব্যয় করেছেন ৩০ লাখ ৭৫ হাজার ৫০২ টাকা। এর সিংহভাগ ২৬ লাখ ৫৪ হাজার ২৮৮ টাকা তিনি ব্যয় করেছেন উৎসবের পেছনে।
আয়-ব্যয়ের এমন অসঙ্গতিপূর্ণ খতিয়ান আমিরুল ইসলাম দিয়েছেন তার ২০২০-২১ অর্থবছরের আয়কর বিবরণীতে।
অনিয়মের কারণে প্রকল্প থেকে সরিয়ে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা এই কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে নিয়মিত বড় অঙ্কের লেনদেন পাওয়া গেছে। তিনি মোহম্মদপুর এলাকায় নিয়মিত জমি কেনাবেচা করেছেন। এইসব কেনাকাটায় অস্বাভাবিক মূল্য দেখানো হয়েছে।
শিক্ষা ভবন সূত্র ও আয়কর বিবরণী থেকে জানা যায়, সাবেক পিডি আমিরুল ইসলাম বর্তমানে মোট বেতন পান ৬১ হাজার ২০০ টাকা। এই বেতন ও একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া ছাড়া তার আর কোনো বৈধ আয়ের উৎস নেই।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে, আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে বিষয়টা সঠিক না। উৎসব ব্যয় এত টাকা হয় নাকি? এসব অভিযোগ মিথ্যা।’
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক প্রকল্প পরিচালক আমিরুল ইসলাম
কত জমির মালিক তিনি?
আমিরুল ইসলাম গত কয়েক বছরে ঢাকা জেলার মোহাম্মদপুর থানাধীন রামচন্দ্রপুর মৌজায় মোট ১৪টি প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে চারটি প্লটে আবাসিক ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। নবীনগর হাউজিংয়ের ৩ নম্বর রোডের দক্ষিণ মাথায় সিটি জরিপের ৫২০১, ৫২০২, ৫২০৫ নং দাগের ২০.৩৪ শতাংশ জমির উপর চলছে ১৪ তলা একটি আবাসিক ভবন নির্মাণের কাজ। এই ভবনের ৩৩টি ২২০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের মধ্য ২৮টি বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে তিনি বিক্রি করেছেন এবং পাঁচটি ফ্ল্যাট এখনও অবিক্রিত আছে বলে জানা যায়।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের আয়কর বিবরণীতে তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার রামচন্দ্রপুর মৌজায় মোট পাঁচটি জমির তফসিল দেখিয়েছিলেন। এই পাঁচটি জমির মধ্যে ৮৮০৭ ও ৮৮১৩ নং দাগে ৯.৯ শতাংশ জমির ক্রয়মূল্য উল্লেখ করেছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয়কর রিটার্নে সম্পদ বিবরণীতে জমিটি বিক্রয় দেখিয়েছেন মাত্র ৮৭ হাজার ৫০০ টাকায়।
মোহাম্মদপুর ভূমি রাজস্ব অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ লোকমান হোসন জানান, ওই এলাকার প্রতি শতাংশ জমির বিক্রি মূল্য অন্তত ৭৫ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ১ কোটি পর্যন্ত বিক্রি হয়। সে হিসেবে প্রায় ১০ শতাংশের ওই জমির সম্পদমূল্য হওয়ার কথা কমপক্ষে সাড়ে সাত কোটি টাকা।
একই মৌজার ৫২০১, ৫২০২ ও ৫২০৫ নং দাগের ২০.৩৪ শতাংশ জমির ক্রয় মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এই জমির মূল্য হওয়ার কথা কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা। এই জমিতেই যে ১৪ তলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটির ব্যয় তিনি দেখিয়েছেন মাত্র ২৫ লাখ টাকা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মতো জায়গায় ২০.৩৪ শতাংশ জমি ও তার ওপর ১৪ তলা ভবনের মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৩৬০ টাকা।
ওই ভবন নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকৌশলীরা বলছেন, এই জায়গা ও ভবনের মূল্য অন্তত ৫০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া রামচন্দ্রপুর মৌজায় পিডি আমিরুল ইসলামের ২৪.৭৫ শতাংশ আরও একটি জমি আছে। ভূমি নিবন্ধন খরচসহ যার মূল্য তিনি উল্লেখ করেছেন মাত্র ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। জমিটির ওপর একটি ১৩ তলা ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। স্থানীয় ভূমি রাজস্ব অফিসের ভাষ্যমতে, শুধু জমির মূল্যই কমপক্ষে ২৪ কোটি টাকা।
শিক্ষা ভবনের সাবেক পিডি আমিরুল ইসলামের নিয়োগ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ে আমিরুল ইসলামের নামে ছয় কাঠার একটি প্লট ফাঁকা পড়ে আছে। প্লটটির সামনের অংশে রাস্তা তৈরি না হওয়ায় নির্মাণ কাজ হাতে নেয়া যায়নি।
আমিরুল ইসলাম তার আয়কর রিটার্নে তার মোট সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছেন ১ কোটি ১৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকার।
সরকারি চাকরি করে জমির ব্যবসা?
জমিগুলোর কেনার রেকর্ড ঘাটলে দেখা যায়, যে সময় আমিরুল ইসলাম শিক্ষা ভবনের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব নেন, সেই সময় থেকেই জমিগুলো কেনা হয়েছে। তিনি প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন শুরু করেন ২০১১ সালে। জমিগুলো কেনা হয় ২০১৩ সালের পর থেকে। সর্বশেষ দুই প্রকল্পে আর্থিক অনিয়ম প্রমাণ হওয়ায় তাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
শিক্ষা ভবনের একাধিক সূত্র বলছে, পিডি আমিরুল ইসলাম চাকুরীজীবী হিসেবে পার্টটাইম হলেও পূর্ণকালীন জমির ব্যবসায়ী। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, তার এমন কাজ করার কোনো বিধানই নেই। তা ছাড়া তার জমি ক্রয়ের অর্থের উৎস কোথাও উল্লেখ করা নেই।
এসব সম্পত্তির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে আমিরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ছোট ছোট সমবায়ের মাধ্যমে এগুলো কিনেছি।’
সমিতির মাধ্যমে কেনা জমি কিভাবে তার নামে কেনাবেচা হয়েছে, জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কোনো জবাব দেননি।
ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেন
মহানগরীর মোহাম্মদপুর আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেডের ১২০১০১৬২৪৯০৩১ নম্বর হিসাব বিবরণীতে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ওই হিসাবে মোট লেনদেন হয়েছে ১৬ লাখ ৫৬ হাজার ৩০১ টাকার, যা আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়নি। এই ব্যাংক হিসাবের হিসাবধারী আমিরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী শায়লা আক্তার। আমিরুল-শায়লা দম্পতির স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গুলশান শাখায় ০১-১৩৩৭৩৪০ নম্বর হিসাব নম্বরের আরও একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এই হিসেবে শুধু কয়েক মাসেই ২০১৯ সালে জমা হয়েছে ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
প্রকল্পে দুর্নীতি
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা ভবনের এক কর্মকর্তা জানান, আমিরুল ইসলাম মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) যোগদান ও প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তার সম্পদের পরিমাণ হুহু করে বেড়েছে।
আমিরুল ইসলাম গত ১১ বছর ধরে মাউশিতে প্রকল্পের দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ‘ঢাকা শহরের সন্নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প’ এবং ‘মহানগরীতে ছয়টি মহাবিদ্যালয় ও ১১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প’ নামে একসঙ্গে দুটি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
এর মধ্যে প্রথম প্রকল্পটিতে অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানোর কারণে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোমিনুর রশিদ আমিনকে সভাপতি করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটির অন্য দুজন সদস্য ছিলেন মাউশির পরিচালক অধ্যাপক মো. আমির হোসেন, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের অডিট অফিসার ফরিদ উদ্দিন।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঢাকা শহরের নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পে বাস্তবে কোনো বৃহৎ গাছপালা ও অবকাঠামো না থাকা সত্ত্বেও গাছপালা ও অবকাঠামো উল্লেখ করে প্রায় ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা দুরভিসন্ধিমূলক। সুতরাং বলা যায়, দুর্নীতির শুরু প্রাক্কলন থেকেই। এ কারণে আমিরুল ইসলামকে প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে প্রত্যাহার করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হলো।’
আমিরুল ইসলামের অভিযোগের ব্যাপারে শিক্ষা ভবনের মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ফারুকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পে কাজ করার সময় সাবেক পিডি আমিরুল ইসলামের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল। সে জন্য তাকে ওএসডি করা হয়েছে। আমিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে আরও তদন্ত চলছে, তদন্তে কোনো কিছু প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’