বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের একুশ শতকের উন্নয়ন ও অর্থনীতির পাওয়ার হাউজ হিসেবে অভিহিত করেছেন মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ শহীদ।
বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন তিনি। এ সময় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কাউকে সংঘাত তৈরির সুযোগ না দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ একমত হয়েছে বলেও জানান মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
আব্দুল্লাহ শহীদ বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের একুশ শতকের উন্নয়ন ও অর্থনীতির পাওয়ার হাউজ বাংলাদেশ। দেশ হিসেবে ছোট হলেও বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলের জন্য খুবই গুরুত্বপূরণ। তাই আঞ্চলিক শান্তি ও পারস্পারিক সমৃদ্ধির স্বার্থে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ একমত হয়েছি যে, এই অঞ্চলে কাউকে অযাচিত কনফ্লিক্ট তৈরি করতে দেয়া হবে না।’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মেদ সোলিহ, পররাষ্ট্রমন্ত্ৰী আব্দুল্লাহ শহিদ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্ৰীসহ ২৭ সদস্যের প্রতিনিধিদল।
সংবাদ সম্মেলনে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম এবং জীবন চর্চাও প্রায় এক। মালে সব সময়ই ঢাকার প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ আমাদের যে কোনো দুর্যোগ ও প্রয়োজনে সবার আগে বাংলাদেশ এগিয়ে আসে।’
করোনা মহামারির সময়ে মালদ্বীপকে করা বাংলাদেশের সহায়তা নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ মোকাবেলায়ও বাংলাদেশ আমাদের খাদ্য, পানি, ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী ও চিকিৎসক নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।’
মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েও মানবতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মালে ঢাকার পাশে থাকবে।’
মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ শহীদ বলেন, ‘দুই দেশ পারস্পারিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমাদের পক্ষে পারস্পারিক স্বার্থে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়াই সম্ভব। আমরা আমাদের উন্নয়নে পারস্পারিকভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ আমাদের প্রচুর রিসোর্স আছে। মালদ্বীপে প্রতি বছর দুই মিলিয়ন পর্যটক আসে।’
মালদ্বীপের মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগই বাংলাদেশি। সেখানে কাগজপত্র ছাড়া থাকা বাংলাদেশিদের নিয়মিত করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে কথা বলেছি। মালে এ নিয়ে কাজ করছে। শুধু এটা বলতে পারি আমাদের দুই দেশের পক্ষে আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়াই সম্ভব।’
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে পারস্পারিক বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে অত্যন্ত চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক সম্প্রতি আরও গভীর হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধান সলিহর বাংলাদেশ সফর দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট সোলিহর মধ্যে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে একটি বৈঠক হয়েছে। উভয় নেতা দুই দেশের সম্পর্কের সার্বিক দিক পর্যালোচনা করেন। তারা উভয় দেশের বিভিন্ন সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোতে পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
তিনি আরও জানান, বৈঠকে দুই দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, মালদ্বীপে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণ, মানবসম্পদ ও যুব সম্প্রদায়ের উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ওষুধসামগ্রী নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া কৃষি, সামুদ্রিক সম্পদ ও মৎস্য, পর্যটন, সংস্কৃতি, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, দুই দেশের মধ্যে বিমান ও নৌযোগাযোগ বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সমস্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও প্রশমন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও বিস্ময়কর সফলতার প্রশংসা করেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, আলোচনা শেষে দুই দেশের মধ্যে চারটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এগুলো হলো দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক সহযোগিতার জন্য যৌথ কমিশন গঠন, দ্বিপাক্ষিক ফরেন অফিস কনসালটেশন, মৎস্য বিষয়ক ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ এবং ২০২২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সংস্কৃতি বিনিময়।
বৈঠকে শেখ হাসিনা- সোলিহ দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্ভাবনা উন্মোচনের ওপরও জোর দেন বলে জানান তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বৈঠকে বাংলাদেশ মালদ্বীপের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) সইয়ের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে বিশ্বমানের বিভিন্ন সামগ্রী আমদানি করতেও মালদ্বীপের প্রতি আহ্বান জানান।
মন্ত্রী জানান, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বিষয়ক সমস্যা দূর করতে বিস্তারিত আলোচনার জন্য উভয় দেশের বাণিজ্যসচিব পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠানের বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়েছে।
এ কে মোমেন বলেন, ‘শুল্ক সহযোগিতা ও দ্বৈত কর পরিহার বিষয়ক প্রস্তাবিত চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি দ্রুত চূড়ান্ত করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে উভয় পক্ষ। এছাড়া মালদ্বীপের রাজধানী মালে ও বাংলাদেশের তিনটি সমুদ্রবন্দরের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্যিক জাহাজ চালু করতে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে দুই নেতার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বৈঠকে মালদ্বীপের মানবসম্পদ উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে বাংলাদেশের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়টি পুনরায় জানান শেখ হাসিনা। মালদ্বীপের শান্তিরক্ষীদের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস সাপোর্ট অপারেশনস ট্রেইনিংয়ের (বিপসট) মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।
মন্ত্রী জানান, বৈঠকে দেশটিতে অবস্থানরত সব প্রবাসীকে বিনামূল্যে টিকা দেয়ার বিষয়ে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির ঘোষণার প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টিকা দানে সহায়তার জন্য বাংলাদেশের ১৮ সদস্যের চিকিৎসক ও নার্সের একটি দল মালদ্বীপে পাঠানো হয়েছে। মালদ্বীপের চিকিৎসক ও নার্সের চাহিদা মেটানোর জন্য সেদেশে বাংলাদেশি চিকিৎসক ও নার্স পাঠানোর অনুরোধ করেছেন প্রেসিডেন্ট সোলিহ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ৮০ জন চিকিৎসক পাঠানোর কথা জানান শেখ হাসিনা।
এর আগে থেকেই বাংলাদেশের দুই শতাধিক চিকিৎসক মালদ্বীপে কর্মরত আছেন বলে জানান আব্দুল মোমেন।
সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে উভয় নেতা জাতিসংঘ, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামসহ (সিভিএফ) বিভিন্ন বহুপাক্ষিক ফোরামে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার বিষয়ে একমত হয়েছেন।
আব্দুল মোমেন বলেন, ‘২০২১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সভাপতি পদে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অফিসের আঞ্চলিক পরিচালক পদে ২০২৩ সালের জন্য বাংলাদেশি প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন দানের জন্য মালদ্বীপকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশকে সমর্থন দেবে মালদ্বীপ।
তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মালদ্বীপ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। প্রধানমন্ত্রী এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দুই দেশের সুবিধাজনক সময়ে মালদ্বীপ সফরের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।