সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে নেয়া একটি সিদ্ধান্তের পর থেকে চাঙা অবস্থা থেকে যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে, সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না পুঁজিবাজার। যদিও আশা করা হচ্ছিল, এই সিদ্ধান্তটি বাজারে তারল্য আরও বাড়াবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি পুঁজিবাজারকে আরও গতিশীল করতে গত কয়েক মাসে নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেগুলোর প্রশংসা হচ্ছিল।এসব সিদ্ধান্তের একটি ছিল মার্জিন ঋণের সুদহার নির্দিষ্ট করে দেয়া। নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে, ব্রোকারেজ হাউজ বিনিয়োগকারীদের ঋণ নিয়ে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ সুদ নিতে পারবে। তবে আমানতের তুলনায় ঋণের সুদহার ৩ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। অর্থাৎ ব্রোকারেজ হাউজ যদি ৬ শতাংশ সুদে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে তারা ঋণের সুদ নিতে পারবে ৯ শতাংশ।বর্তমানে মার্জিন ঋণে সুদহার নির্দিষ্ট না থাকায় কোনো কোনো হাউজ ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিয়ে থাকে, যদিও এখন দেশে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ।
১৪ জানুয়ারি বিএসইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সিদ্ধান্তটি কার্যকর হবে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে।
গত ডিসেম্বর থেকে পুঁজিবাজারে উত্থানের পর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিনই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইর সূচক ছিল সর্বোচ্চ অবস্থানে, ৫ হাজার ৯০৯ পয়েন্টে। লেনদেন ছিল ২ হাজার ৭০ কোটি টাকা।
এই সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের আরও আশান্বিত করলেও পরের দুই দিনে সূচক পড়ে ১০৯ পয়েন্ট। এর পর তিন দিন অল্প অল্প করে সূচক বাড়ে ৩৬ পয়েন্ট।এরপর থেকে ওঠানামা করতে করতে সূচক পড়ার পাশাপাশি কমতে থাকে লেনদেন।এর মধ্যে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর অনুরোধে বিএসইসি এই সিদ্ধান্ত কার্যকরে পাঁচ মাস পেছায়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ সুদহার কার্যকর হবে আগামী জুলাই থেকে।
নতুন সিদ্ধান্তেও বাজারে তারল্য বাড়েনি। যে বাজারে জানুয়ারিতে টানা ১০ দিন গড়ে ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা এবং টানা ৪০ দিন এক হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, সেখানে এখন গড় লেনদেন ৬০০ কোটি টাকার ঘরে। মাঝে তা ৫০০ কোটি টাকারও নিচে নেমে আসে।
মঙ্গলবার সূচকের অবস্থান দাঁড়ায় ৫ হাজার ৫১৬ পয়েন্ট। সেদিনও সূচক পড়ে ১৬ পয়েন্ট, লেনদেন হয় ৬৯৮ কোটি টাকা।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি পুঁজিবাজারকে আরও গতিশীল করতে গত কয়েক মাসে নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেসব প্রশংসা পায়। ছবি: নিউজবাংলা
যদিও আগের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বিএসইসির বৈঠকে বেশ কয়েকটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত এসেছিল। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে একটি বাধা কাটানোর সিদ্ধান্ত হয় সেদিন। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা শেয়ারের বাজারমূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে গণনার যে দাবি ছিল গত সাত বছর ধরে, সেটি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে শেয়ারের দাম বাড়লে ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে তা বিক্রি করে দিতে হবে না।
এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের সীমা বেঁধে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নির্দেশ দিয়েছিল, তাতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন থেকে আরও বেশি লভ্যাংশ দিতে পারবে কোম্পানিগুলো। আরও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত আসে যা পুঁজিবাজারবান্ধব হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
এর পরদিনও সূচক পতন ভাবিয়ে তুলেছে বিনিয়োগকারীদের। এই পরিস্থিতিতে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে কথা উঠেছে, মার্জিন ঋণের সুদহার নিয়ে সিদ্ধান্তের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে কি না।
মাঝে দুই দিনে ২০০ পয়েন্টের বেশি সূচক পতনের পর বিএসইসির সার্ভেইলেন্স টিম জানতে পেরেছে, ১১টি ব্রোকারেজ হাউজ থেকে অতিরিক্ত বিক্রয়ের চাপ এসেছে। এই হাউজগুলোর বেশির ভাগই বড় অঙ্কের মার্জিন ঋণ বিতরণ করে থাকে। এ নিয়ে তদন্তও চলছে।
মার্চেন্ট ব্যাংক ব্র্যাক ইপিএলের গবেষণা বিভাগের সাবেক প্রধান দেবব্রত কুমার সরকার মনে করেন, বিএসইসির সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজারে মার্জিন ঋণ কমেছে। তিনি বলেন, বিএসইসির নির্দেশনার বাস্তবায়নের সময়সীমা পেছানো হলেও এখন থেকেই পুঁজিবাজারে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সতর্কাবস্থায় ঋণ প্রদান করছেন। ফলে লেনদেন কিছুটা ধাক্কা লেগেছে।
লেনদেনে প্রভাব
১৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার মার্জিন ঋণ নিয়ে নির্দেশনা জারির পর প্রথম কার্যদিবস ১৭ জানুয়ারি পুঁজিবাজারে লেনদেন হয় ২ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা।
এরপর আর পুঁজিবাজার দুই হাজার কোটি টাকার ঘরে যেতে পারেনি।
গত ২৭ জানুয়ারি সুদহার নিয়ে সিদ্ধান্ত কার্যকর পেছানোর দিন লেনদেন হয় ৯০৫ কোটি টাকা। এরপর কমতে কমতে গত ২২ ফেব্রুয়ারি দাঁড়ায় ৪৬৭ কোটি টাকা।
এরপর থেকে লেনদেন কিছুটা বাড়তে থাকে। এক মাস পর গত ৯ মার্চ লেনদেন এক হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। কিন্তু এরপর আবার কমছে।
মার্চেন্ট ব্যাংক কী বলছে?
মার্জিন ঋণ নিয়ে সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে লেনদেনে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে বলে স্বীকার করেছেন মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সিমিতি বাংলাদেশ মাচেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছাইদুর রহমান।
সিদ্ধান্ত পালটাতে চাপ দিতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো মার্জিন ঋণ দেয়া কমিয়ে দিয়েছে বা নিজেরা শেয়ার কেনা বন্ধ রেখেছে কি না, এমন প্রশ্ন ছিল তার কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, ‘সবকিছুরই ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক আছে। যারা নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছেন তারা কম করে কীভাবে ঋণ দেবে? এটা সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে।’ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার বলেন, মার্জিন ঋণের নির্দেশনার কারণে লেনদেনে নেতিবাচক প্রভাব হতে পারে। তবে এটি একমাত্র কারণ নয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে যেসব মার্চেন্ট ব্যাংক আছে সেগুলোর বেশির ভাগই কোনো না কোনো ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকগুলোকে আলাদা করে ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করতে বলা হয়েছে। এই তহবিল আসার আগ পর্যন্ত ১২ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া কঠিন।
তিনি বলেন, যারা বেশি সুদে ঋণ নিয়েছে, তাদের জুলাইয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। তারা হয় শেয়ার বিক্রি করছেন, নয় পকেট থেকে টাকা দিচ্ছেন। কিন্তু বেশির ভাগেরই নতুন করে টাকা দেয়ার সুযোগ কম। তাই তারা শেয়ার বিক্রি করছেন। এটাও সূচক কমার একটি কারণ।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম নিউজবাংলাকে বলেন, যেসব মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকার হাউজ উচ্চ সুদে ঋণ দেয়েছে তাদের পক্ষে এখন আগের হারে ঋণ দেয়া সম্ভব না। ফলে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন বা সমন্বয় করার জন্য তারা হয় ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেবে না হয় ঋণ দেবে না। ফলে সরাসরি পুঁজিবাজারে প্রভাব ফেলবে।
কীভাবে দেয়া হবে মার্জিন ঋণ
বর্তমানে ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ১ অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ হারে ঋণ দিয়ে থাকে। অর্থাৎ কোনো গ্রাহকের এক লাখ টাকা বিনিয়োগ থাকলে তিনি ৫০ হাজার টাকা ঋণ পাওয়ার যোগ্য হবেন।
গত সেপ্টেম্বরে মার্জিন ঋণের নতুন নির্দেশনা জারি করে বিএসইসি। বলা হয়, মূল্যসূচককের ওপর ভিত্তি করে মার্জিন ঋণের হার নির্ধারণ করা হবে। মূল্যসূচক চার হাজার থেকে সাত হাজার পয়েন্টের মধ্যে থাকলে বিনিয়োগের ৫০ শতাংশ ঋণ দেয়া যাবে। আর সূচক এর ওপরে উঠলে মার্জিন ঋণ দেয়া যাবে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত।