৯ মাসের যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় যেদিন পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, সেদিনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার ধানমন্ডির একটি বাড়িতে অবরুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করেন যৌথ বাহিনীর কয়েকজন ভারতীয় সেনা। যে মানুষটি সেদিন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের জন্য ত্রাতা হয়ে এসেছিলেন, তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল অশোক তারা।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্থপতির পরিবারকে উদ্ধার করেন সেদিনের ২৯ বছর বয়সী তরুণ অশোক। ৫০ বছর আগের সেই স্মৃতি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীসহ নানা বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন ডিএনএ ইন্ডিয়ার সঙ্গে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২৬ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
১৯৭১ সালে যে বাড়িটি থেকে অশোক শেখ হাসিনা, তার শিশুসন্তানসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করেছিলেন, এবারের সফরে ধানমন্ডির সেই বাড়িতে যাওয়ার কথা রয়েছে মোদির।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে অশোক তারা বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার বার্তা হলো, ভারতীয় ও বাংলাদেশিরা ভাই ভাই…আমরা একটি পরিবার হয়ে থাকতে চাই।’
চলতি বছরের ১৭ ডিসেম্বর মোদির সঙ্গে এক ভার্চুয়াল বৈঠকের সময়ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মরণ করেন অশোক তারাকে। সেদিন বলেন, ‘আজ আমার জন্য একটি বিশেষ দিন। ১৭ ডিসেম্বর, পাকবাহিনীর অধীনে তখনও আমার মা, রেহানা, রাসেল, আমি ও ছোট চার মাসের জয় বন্দি ছিলাম। ভারতের কর্নেল অশোক তারা এসে এই দিন সকালে আমাদের সেই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন।
‘১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্ত হয়, আমরা ১৭ ডিসেম্বর মুক্ত হই। আজকের এই দিনে কর্নেল অশোক তারাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। ভারতের সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সবার জন্যই আমার কৃতজ্ঞতা। সেদিন আমরা যারা মুক্ত হয়েছিলাম শুধু জয়, আমি আর রেহানাই বেঁচে আছি, আর কেউ বেঁচে নেই।’
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বাংলাদেশের জাতির পিতার পরিবারকে উদ্ধারের দিনের বর্ণনায় অশোক তারা বলেন, ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় তাকে (শেখ হাসিনা) খুবই সংকটময় একটি পরিস্থিতিতে উদ্ধার করা হয়। কেননা, তখন পাকিস্তানিরা বাড়িটি পাহারা দিচ্ছিল। বাড়িটির নাগালে যেতে চাওয়া যে কাউকে তারা গুলি করছিল। আমি যখন বাড়িটির কাছে গেলাম, আমাকে থেমে যেতে হয় এবং আমি একজন সংবাদকর্মীর মরদেহ দেখতে পাই। আমার সঙ্গে মাত্র দুজন জওয়ান ছিল এবং বাড়িটিতে আক্রমণের কোনো প্রশ্নই ছিল না, কারণ, বাড়ির ভেতরে মানুষ ছিল, তাদের জীবন হুমকিতে পড়ে যেতে পারত।
‘সাহস এবং বুদ্ধি খাটিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিই, পাকিস্তানিদের মুখোমুখি হওয়ার। দুই জওয়ানসহ আমি অস্ত্রগুলো ফেলে দিই, তাদের পেছনে থাকতে বলি।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর মুক্ত করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল অশোক তারা। ছবি: সংগৃহীত
‘কোনো অস্ত্র ছাড়াই আমি বাড়িটির দিকে এগিয়ে যাই। বাড়ির কাছে পৌঁছে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ আছে কি না। তারা (পাকিস্তানি সেনারা) আমার সঙ্গে পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলল এবং আমি পাঞ্জাবি হওয়ায় তাদের আমি ভাষাটি বোঝতে পারতাম। তারা আমাকে থামতে বলে, অন্যথায় তারা গুলি করবে।
‘আমি তাদের বলি, আমি সেনা অফিসার, এখানে এসেছি তোমাদের বলতে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে।
‘তারা বিশ্বাস করছিল না। বরং জবাবে তারা আমাকে খুব বাজে ভাষায় গালাগাল করে। কিন্তু আমি চুপ থাকি, কারণ আমি জানতাম, আমার দায়িত্ব কী, আমার লক্ষ্য কী।
‘আমি আবারও তাদের পরিস্থিতিটা বুঝতে বলি। তখনই ভাগ্যক্রমে একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার বাড়িটির ওপর দিয়ে উড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমি তাদের বলি, হেলিকপ্টারটি দেখুন, আপনারা কী কখনও আপনাদের মাথার ওপর ভারতীয় হেলিকপ্টার উড়তে দেখেছেন।
‘বিষয়টি বুঝতে পারলেও তারা বলে, আত্মসমর্পণের বিষয়ে তারা ঊর্ধ্বতন অফিসারদের জিজ্ঞেস করবে। ওই সময় আমি ঠিক গেটে ছিলাম। আমার শরীরের ডান দিকে রাইফেলের বেয়োনেট লাগানো ছিল। আমি যখন কথা বলছিলাম, শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী সাহস করে জোরালো কণ্ঠে বললেন, তারা নিষ্ঠুর, তারা যেকোনো কিছুই করে ফেলতে পারে।আমি তাদের (পাকিস্তানি আর্মি) বললাম, টেলিফোন লাইন কেটে ফেলায় যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। আরও বললাম, দেরি করলে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনারা তোমাদের মারতে আসবে। পাকিস্তানে অপেক্ষায় থাকা পরিবারের সঙ্গে তোমাদের দেখা হবে না। তোমাদের মরদেহের কী গতি হবে, তা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না।
‘এভাবে কথাবার্তা চলেছিল ২৫ মিনিট। এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর ওই দলের কমান্ডার বন্দুকে গুলি লোড করল। বাড়ির অন্যান্য মানুষের ওপর তখনও সে গুলি চালিয়ে চাচ্ছিল। আমি দাঁড়িয়ে থাকি, তাদের বলি, এই ভয় আমার ওপর প্রভাব ফেলবে না। কারণ, এটা হলে আমার চেয়ে তোমাদেরই বেশি ক্ষতি হবে। তোমরা এখানে ১২ জন, সবাইকে মারা হবে; কখনও বাড়ি ফিরতে পারবে না।
‘যদি আত্মসমর্পণ করো, একজন ভারতীয় সেনা অফিসার হিসেবে কথা দিচ্ছি, আমি তোমাদের হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাব, যাতে তোমরা পাকিস্তানে তোমাদের বাড়িতে পৌঁছাতে পার। একপর্যায়ে তারা সম্মত হয় এবং আত্মসমর্পণ করে।
‘আমি তখন, বাড়িটির দরজা উন্মুক্ত করি। প্রথম যে নারী বের হয়ে আসেন, তিনি ছিলেন মিসেস শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আমাকে বুকে টেনে নেন। বলেন, তুমি আমার ছেলে এবং আমাদের উদ্ধারে সৃষ্টিকর্তা তোমাকে পাঠিয়েছেন।
‘ওই সময় শেখ মুজিবুর রহমানের এক আত্মীয় ও মুক্তিযোদ্ধা আমার হাতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলে দেন। আমাকে বলেন, পাকিস্তানি পতাকা ফেলে ওই পতাকা ওড়াতে।‘আমি এগিয়ে যাই। ওই পতাকা ওড়াই এবং পাকিস্তানি পতাকা মাটিতে ফেলে দিই। মিসেস শেখ মুজিবুর রহমান বাঘিনীর মতো গর্জে ওঠেন। পাকিস্তানি পতাকা পা দিয়ে মাড়িয়ে বলেন, “জয় বাংলা”। এ সময় আরও মানুষ যোগ দেয়। তারা (পাকিস্তানি সেনা) আত্মসমর্পণ করেছিল আমি তাদের পাঠিয়ে দিই।…
‘আমার দ্বারা তার পরিবার উদ্ধার হয়েছে, এটা যেকোনোভাবে জানতে পেরে শেখ মুজিবুর রহমান আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। কয়েক দিন পর আমার ব্যাটালিয়ন মিজোরামের উদ্দেশে রওনা হয়। তবে আমাকে থাকতে বলা হলো। কয়েক দিন পর মিসেস শেখ মুজিবুর রহমান তাদের উদ্ধার করায় আমাকে একটি উপহার দেন।
‘১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে ঢাকায় আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১২ তারিখ তিনি তার বাড়িতে আমাকে দাওয়াত করেন। আমরা নাশতা করি। তার সঙ্গে কথা বলার সময় আমি দুঃখকষ্ট, জনগণের ক্ষত কীভাবে সেরে উঠছে, কীভাবে তারা তাদের মর্যাদা, গর্ব, সংস্কৃতি, ভাষা ও দেশের অর্থনীতি ফিরে পেয়েছে, তা দেখতে পাচ্ছিলাম। তিনি ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন।
‘২৩ জানুয়ারি মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার আবার আমাকে আমন্ত্রণ করে। কারণ, তারা আমাকে বিদায় জানাতে চেয়েছিল। তখন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার তিন মাস বয়সী ছেলের সঙ্গে তোলা একটি ছবি দেয়। ছবিটির পেছনে লেখা ছিল, “জয় বাংলা”।
‘আমি দিল্লিতি চলে আসি। শেখ হাসিনার ছোট বোনের কাছ থেকে দুটি চিঠি পাই। পুরস্কার প্রদানের জন্য ২০১২ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আমাকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানান। পুরস্কারটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ। এটা দেয়া হয়েছিল ২০ অক্টোবর, ২০১২ সালে।’
বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধন কীভাবে দেখছেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে আশোক তারা বলেন, ‘যুদ্ধের পরপরই দুই দেশের সম্পর্ক খুব গভীর হয়। কিন্তু তিন বছর পর শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর স্বৈরশাসন এলে সম্পর্ক বাজে রূপ নেয়। এরপর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবার ক্ষমতায় এলে সম্পর্ক দুর্দান্তরূপে ফেরে। বর্তমান (ভারত) সরকারও তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চায়।
‘দুই দেশের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী মোদি অনেকবার বলেছেন। এই মুহূর্তে সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। আমি চাই, এই সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আপনার বার্তা কী? এ প্রশ্নের জবাবে অশোক তারা বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার বার্তা হলো, ভারতীয় ও বাংলাদেশিরা ভাই ভাই। উভয়ের সংস্কৃতি ও মার্যাদার বিষয়টি একই। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সম্ভাব্য অন্য সব ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই একে অপরকে সম্মান করব এবং সহযোগিতা করব।’
বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাদের ভাস্কর্য নির্মাণ পরিকল্পনা নিয়ে অশোক তারা বলেন, আমাদেরও উচিত বাংলাদেশি সেনাদের তুলে ধরা। সেখানে অবশ্যই নিজ নিজ পতাকাসহ ভারতীয় ও বাংলাদেশি সেনাদের উপস্থাপন থাকতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমরা একসঙ্গে লড়াই করেছি।