আবারও আলোর মুখ দেখতে যাওয়া গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পে প্রতিবেশী দেশ ভারতও যুক্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পানিসম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ার।
ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে বুধবার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কবির বিন আনোয়ার এ কথা জানান।
সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, ‘ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসচিবের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা কেবল ব্যারাজই নয়, একটি মাল্টি ফাংশনাল প্রজেক্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরই মধ্যে তারা এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে দুই দেশের একটি যৌথ কমিটি করার কথা বলেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই কমিটি প্রকল্পের সমীক্ষার কাজ শুরু করবে।’
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কৃষি, পরিবেশ ও প্রতিবেশের কথা চিন্তা করে এই মেগা প্রকল্পে গুরুত্ব দেয় শেখ হাসিনার সরকার।
২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল ভারত সফর করে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নকশাগত ত্রুটির কথা বলে চার বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প বাতিল করে দেন। তবে এবার ভারত প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সঙ্গে থাকার সম্মতি দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ‘গঙ্গা ব্যারাজ বাতিল করেছি’ বক্তব্য অনেকেই বুঝতে পারেননি। মূলত নকশাগত ত্রুটির কথা বলে সরকার গঙ্গা ব্যারাজের স্থান পরিবর্তন করতে চেয়েছিল।
বুধবার পানিসম্পদ সচিব জানান, নকশার পরিবর্তন এনে কেবল ব্যারাজই নয়, প্রকল্পটিকে একটি মাল্টি ফাংশনাল ধারণায় রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। গঙ্গার উৎস দেশ ভারতও প্রকল্পটিকে গুরুত্ব দিয়ে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘গঙ্গা ব্যারাজের বিষয়ে ২০১৯ সালে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যে শুধু ব্যারাজ না, ব্যারাজের সঙ্গে পানি ধরে রাখার আমাদের কী কী অলটারনেটিভস আছে তার ওপর ভিত্তি করে। ভারতের সঙ্গে আমাদের যে পানিবণ্টন চুক্তি আছে, সেটি ২০২৬ সালে শেষ হবে। এর আগে পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের উপায় আমাদের খুঁজতে হবে। এটা ব্যারাজ হতে পারে। ড্রেজিং হতে পারে। অন্য জলাধার তৈরি করা হতে পারে। এসব খতিয়ে দেখার জন্যই একটি জয়েন্ট টেকনিক্যাল টিম গঠন করা হচ্ছে।’
তিনি জানান, এর জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সার্ভের কাজ শুরু হবে।
গঙ্গা ব্যারাজের বিষয়ে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম বলেন, এ প্রকল্প এখন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে। তিনি নিজে এটার বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে কাজ করছেন। গঙ্গা ব্যারাজের নকশা ও স্থান নিয়ে কথা আছে, কিন্তু প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কারও মতপার্থক্য নেই। এই প্রকল্পের আর্থিক গুরুত্ব প্রায় ‘পদ্মা সেতু’র সমান।
তিনি বলেন, সরাসরি ‘গঙ্গা ব্যারাজ’ সুবিধা ভোগ করবে দেশের ৩৭ শতাংশ এলাকা ও সেখানকার মানুষ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ হেক্টর একর জমি এক ফসলি থেকে তিন ফসলিতে পরিণত হবে। লবণাক্ততা দূর হবে। নদী তার স্রোত ফিরে পাবে। উদ্ধার হবে হারানো নৌপথ। সেচের আওতা বাড়বে। সুন্দরবনের প্রাণ ও প্রকৃতি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
ব্যারাজ নিয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে প্রকল্পে বিনিয়োগের টাকা উঠে আসবে। তবে এটা এমন নয় যে, চার বিলিয়ন ডলার ছয় বছর পর বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে জমা হবে। সার্বিকভাবে টাকাটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে এবং জিডিপিতে এর প্রভাব হবে দুই পয়েন্ট।
প্রকল্পে ভারতের অংশগ্রহণ সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিউজবাংলাকে জানিয়েছে, গঙ্গা বা পদ্মা নদী যেখান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে ভাটিতে বহু কিলোমিটার পর্যন্ত এক পাশে ভারত ও অন্য পাশে বাংলাদেশ। তাই ভারতেরও একটি বড় অংশ এই ব্যারাজের সুবিধা ভোগ করবে। এ কারণে ভারতকে প্রকল্পের অংশীদার করতে চায় বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর কথা, ভারতকে এই প্রকল্পে অংশীদার করলে এর প্রতি তাদের একটা ভালোবাসা থাকবে। দায়িত্ববোধ থাকবে।
২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল প্রকল্প বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরই চীনের পানিসম্পদমন্ত্রীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসে। ওই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর সে সময়ের পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। প্রধানমন্ত্রীও কিন্তু স্পষ্ট করে বলেছেন। গঙ্গা প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন নেই, ব্যারাজ প্রজেক্ট হবে… প্রশ্ন হচ্ছে নকশার, কোথায় হবে? কীভাবে হবে?
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, গঙ্গা ব্যারাজে অর্থের সংকট নেই। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে জাপান যে ছয় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিল, সেখানে গঙ্গা ব্যারাজের জন্য টাকা রাখা আছে। আবার চীন নিজেই এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ টাকা বিনিয়োগ করতে চায়। চীনের থ্রি গর্জেজ ড্যাম নির্মাণকারী দুই কোম্পানির কনসার্টিয়াম এই ব্যারাজ নির্মাণ ও বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে। অন্যান্য দেশও আগ্রহী। এ ধরনের একটি প্রকল্পে বাংলাদেশ নিজেও দুই বিলিয়ন ডলার বিনিযোগ করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।
যৌথ নদী গঙ্গার অববাহিকার পানি সংরক্ষণের জন্য ১৯৬২-৬৩ সালে প্রথমবারের মতো গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের বিষয়ে জরিপ হয়। এরপর ২০০৫ সালে ওই ব্যারাজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কাজ শুরু হয়। ২০১১ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য বলে বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা মত দেন। ভারতকে ওই প্রকল্পের সারসংক্ষেপও হস্তান্তর করা হয়।
সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৪০০ কিউসেক। ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে একই পয়েন্টে পানির পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ৯ হাজার ৬৯৮ কিউসেক।
বাতিল হওয়া আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী গঙ্গা ব্যারাজের মাধ্যমে ১৬৫ কিলোমিটার লম্বা একটি জলাধার তৈরির কথা ছিল, যার পানি ধারণক্ষমতা হতো ২.৯ বিলিয়ন ঘনমিটার। মূল গঙ্গা ব্যারাজের দৈর্ঘ্য ছিল ২.১ কিলোমিটার। এটি তৈরি করতে সাত বছর লাগার কথা। প্রকল্পের সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা তৈরির কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালে, শেষ হয় ২০১৪ সালে।