করোনা সংক্রমণ আবার ঊর্ধ্বমুখী থাকার পরিপ্রেক্ষিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সম্ভব হলে লকডাউনে যাওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
যদিও অধিদপ্তরের করোনা মোকাবিলায় গঠন করা কারিগরি কমিটির একজন সদস্য মনে করেন, লকডাউনে যাওয়া সম্ভব নয় বাংলাদেশের জন্য।
সরকার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও অধিদপ্তর ভাবছে উল্টো কথা। তারা যেসব প্রতিষ্ঠান খোলা আছে, সেগুলোও এখন বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে। এমনকি দুই দিন পর হতে যাওয়া সরকারি কর্মকমিশনের ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা স্থগিত করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
গণপরিবহনে যাত্রী সীমিত করা, জনসমাগম কমানোর পরামর্শও দেয়া হয়েছে।
প্রস্তাবগুলো এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে পাঠানো হয়েছে।
মঙ্গলবার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মো. খুরশীদ আলমের সভাপতিত্বে এক জরুরি সভায় এসব পরামর্শসহ মোট ১২টি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
অধিদপ্তরের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রস্তাবগুলো সভায় আলোচনা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে আজও আলোচনা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নির্দেশনা দিলে সেগুলো বাস্তবায়ন করব আমরা।’
এই প্রস্তাবের বিষয়ে মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু বিষয়ে আলোচনা করেছে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সভায়। পরে মূল বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখানে বলা হয়েছে, লকডাউন এখনই নয়, তবে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়। আর বিসিএস পরীক্ষার ফলে সংক্রমণ বাড়ার সুযোগ আছে, এমন আলোচনা হলেও পরে সেটা বন্ধের সুপারিশ করা হয়নি।’
অবশ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক কারিগরি কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম মনে করেন, লকডাউনে যাওয়ার বাস্তবতা নেই বাংলাদেশে।
নিউজবাংলাকে এই চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘১২ দফার বিষয়ে আমি জানি না। তবে করোনার ঊর্ধ্বগতি থাকলেও বাংলাদেশের মতো দেশে লকডাউনের প্রয়োজন নেই। সর্বোচ্চ আমরা মকআপ করতে পারি।’
মকআপের ব্যাখ্যায় তিনি বলন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা।
করোনা মোকাবিলায় প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশ লকডাউনে গেলেও বাংলাদেশ কখনও ওই পথে হাঁটেনি। তবে গত বছরের মার্চে ধাপে ধাপে দুই মাসেরও বেশি সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।
২০২০ সালের মার্চে করোনা সংক্রমণ দেখা দেয়ার পর তা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে।
টানা দুই মাস পরীক্ষার বিবেচনায় সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিতে থাকা, করোনা প্রতিরোধী গণটিকা শুরু হওয়ার পর যখন স্বস্তির আশা করা হচ্ছিল, তখন দুই সপ্তাহ ধরে আবার তা ঊর্ধ্বমুখী।
বুধবার ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৮৬৫ জনের, যা গত তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ২৪ ঘণ্টায় ২৬ জনের মৃত্যুর তথ্য জানানো হয়। গত ৬৭ দিনে এত বেশি মৃত্যু দেখেনি বাংলাদেশ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, পরীক্ষার বিবেচনায় সংক্রমণের হার টানা দুই সপ্তাহ ৫ শতাংশের নিচে নামার পর আবার দুই সপ্তাহ ৫ শতাংশের বেশি হলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বলা যায়। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি হয়ে গেছে, যদিও এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা জানানো হয়নি, যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন জানিয়েছেন, সরকার লকডাউনের মতো সিদ্ধান্তে যাচ্ছে না। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কারিগরি কমিটি মনে করছে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে।
করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ছবি: নিউজবাংলা
মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়েছেন, সম্ভব হলে কমপ্লিট লকডাউনে যেতে হবে, সম্ভব না হলে ইকোনমিক ব্যাল্যান্স রেখে যেকোনো জনসমাগম বন্ধ করতে হবে।
অধিদপ্তর বলছে, কাঁচাবাজার, গণপরিবহন, শপিং মল, মসজিদ, রাজনৈতিক সমাগম, ভোট অনুষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিল, পবিত্র রমজান মাসের ইফতার মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠান সীমিত করতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আগামী ১৯ মার্চ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হতে যাচ্ছে। সরকারি চাকরির সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ৪ লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী।
করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই পরীক্ষা স্থগিতের দাবি করছেন পরীক্ষার্থীদের একাংশ। বিষয়টি গড়িয়েছে হাইকোর্ট পর্যন্ত। তবে মঙ্গলবার এক আদেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেয়ার রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১২ প্রস্তাব
সম্ভব হলে কমপ্লিট লকডাউনে যেতে হবে, সম্ভব না হলে ইকোনমিক ব্যালান্স রেখে যেকোনো জনসমাগম বন্ধ করতে হবে।
কাঁচাবাজার, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, শপিং মল, মসজিদ, রাজনৈতিক সমাগম, ভোট অনুষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিল, পবিত্র রমজান মাসের ইফতার মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠান সীমিত করতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেগুলো বন্ধ আছে, সেগুলো বন্ধ রাখতে হবে। অন্যান্য কার্যক্রম সীমিত রাখতে হবে।
যেকোনো পাবলিক পরীক্ষা (বিসিএস, এসএসসি, এইচএসসি, মাদ্রাসা, দাখিলসহ অন্যান্য) বন্ধ রাখতে হবে।
কোভিড পজিটিভ রোগীদের আইসোলেশন জোরদার করাতে হবে।
যারা রোগীদের সংস্পর্শে আসবে তাদের কঠোর কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে।
বিদেশ থেকে বা প্রবাসী যারা আসবেন তাদের ১৪ দিনের কঠোর কোয়ারেন্টিনে রাখা এবং এ ব্যাপারে সামরিক বাহিনীর সহায়তা নেওয়া।
আগামী ঈদের ছুটি কমিয়ে আনা।
স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে আইন প্রয়োজনে জোরদার করা।
বাংলাদেশের পোর্ট অব এন্ট্রিতে জনবল বাড়ানো, মনিটরিং জোরদার করা।
সব ধরনের সভা ভার্চুয়ালি করা।
পর্যটন এলাকায় চলাচল সীমিত করা।
লকডাউন নয়: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসব প্রস্তাবের বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য পায়নি নিউজবাংলা। তবে মঙ্গলবার রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি লকডাউন না দেয়ার কথাই বলেছেন।
স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই দেশে আবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। জানিয়েছেন, সংক্রমণ বাড়তির দিকে থাকলেও আবার লকডাউন দেয়ার মতো কোনো চিন্তাভাবনা নেই সরকারের।
তিনি বলেন, ‘লকডাউন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত, এ বিষয়ে কোনো চিন্তাভাবনা নেই। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সরকার তবে কী করতে যাচ্ছে- সে প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে সংক্রমণ বাড়ছে। পর্যটন কেন্দ্রে ভিড়, বিয়ে, ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি ছাড়া। গণপরিবহন, রেস্তোরাঁ, পর্যটনে ভিড় কমাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ব্যবস্থা নিতে।’
মন্ত্রী মনে করেন, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সচেতনতায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘গত এক মাসে প্রায় ২০ লাখ লোক ভ্রমণে গেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। তারা স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই এসব করছে৷ বিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। গত এক মাসে এক কোটি মানুষ বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন।
‘করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে উৎপত্তিতে নজর দিতে হবে। টিকা নিলেই করোনা মুক্ত হয়ে যাবেন না। খুব বেড়ে গেলে নিয়ন্ত্রণ নেয়া যাবে না। অত বেড আমাদের নাই। কোনো দেশেরই নাই।’
করোনা নিয়ে সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার এক ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের মধ্যে সকলেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে চলবেন। দ্বিতীয় ওয়েভটা কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে সবাই যেন স্বাস্থ্যবিধিটা মেনে চলেন, সে অনুরোধটা আমার থাকবে। টিকা কর্মসূচি আমরা শুরু করেছি কিন্তু তারপরেও সবাইকে সুরক্ষাবিধি মেনে চলতে হবে।’