উচ্চ আদালত বা নিম্ন আদালতের রায় বা আদেশ জালিয়াতির সঙ্গে যারাই জড়িত, তাদের খুঁজে বের করা জরুরি বলে মন্তব্য করেছে হাইকোর্ট।
এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না ঘটে, সে জন্য এই জালিয়াতদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছে আদালত।
বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ মন্তব্য করে।
জামিন জালিয়াতি করে বগুড়ার ৩০ আসামির জামিনের বিষয়টি ধরা পড়লে ২৪ ফেব্রুয়ারি তাদের গ্রেপ্তারে নির্দেশ দেয় এবং প্রতিবেদন দিতে বলে হাইকোর্ট।
মঙ্গলবার এ বিষয়ে শুনানির পরে জামিন জালিয়াতি করে বগুড়ায় ৩০ আসামি জামিন নেয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন না দেয়ায় বগুড়ার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশও দেয় আদালত।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলও ভার্চুয়ালি যুক্ত হন শুনানিতে। তাকে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে প্রতিবেদনটি দিতে বলা হয়েছে।
শুনানিতে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী বলেন, ‘রুলে আমরা যে নির্দেশ দিয়েছিলাম, সে অনুযায়ী আপনারা আমাদের অবহিত করেননি। আপনারা কি কোনো তথ্য পাননি? নাকি আমাদের নির্দেশনা পর্যন্তই শেষ হয়ে যাবে?’
তখন রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, ‘এই নির্দেশনার বিষয়ে আমাদের নজরে সেভাবে আসেনি। আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। একটু সময় দেন আমরা আদেশ প্রতিপালন করব।’
এরপর বিচারক বলেন, ‘একটা ভুয়া আদেশ নিয়ে তারা জামিন নিল। সিজিএমকে নির্দেশ দিয়েছিলাম বিষয়টি নিশ্চিত করতে। তিনি আমাদের নিশ্চিত করেননি। তিনি কেন জানাননি তাকে আমরা শোকজ করব।
‘আপনারা (রেজিস্ট্রার জেনারেল) জেনে বৃহস্পতিবারের মধ্যে আমাদের জানাবেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আদেশ দেব।’
বিচারক আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে যে ডকুমেন্ট আছে তাতে দেখা যায়, গত ১ তারিখে আপনাদের কাছে তারা সার্ভ (সরবরাহ) করেছেন। আপনাদের উচিত ছিল সাত দিনের মধ্যে দেয়া। সিআইডি থেকে রিপোর্ট এসেছে। সুদূর বগুড়া থেকে এসেছে। আর আপনারা কাছাকাছি থেকেও সেটি করছেন না।
মামলাটি যে জটিল সে প্রসঙ্গ টেনে বিচারক বলেন, ‘মামলাটি অনেক জটিল। এ ধরনের আজকেও একটি মামলা বের করেছি। যেখানে বারবার আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। আমরা আউট অফ লিস্ট করেছি। আবার নিয়ে এসেছে। বাই দিস টাইম দেখা যাচ্ছে, ওই দিক দিয়ে আসামি বের হয়ে চলে গেছে। অনেক জটিল মামলা। লিস্টে আসে, শুনানি করে না। পরবর্তীতে দেখা যায়, ওই দিকে বেইল (জামিন) হয়ে বেরিয়ে যায়। এ রকম যে অহরহ চলছে তা প্রতিরোধ করতে আমাদের সকলের প্রচেষ্টা দরকার।’
আদালত বলে, ‘হাইকোর্টের আদেশ জাল হচ্ছে, নিম্ন আদালতের স্বাক্ষর জাল হচ্ছে। নিম্ন আদালতের আদেশ টেম্পারিং করে আমাদের কাছে আনছে। আপিল বিভাগের এখনও হইছে কিনা আমাদের জানা নাই। এ ধরনের কাজে যারা যুক্ত, তাদের খুঁজে বের করা জরুরি, যাতে পরবর্তী সময়ে আর এ রকম ঘটনা না ঘটে।’
এ সময় আসামিদের পক্ষে আইনজীবী মিনহাদুজ্জামান লিটন আদালতকে বলেন, এ মামলার যারা আসামি, তারা আদেশ পাওয়ার পরপরই আত্মসমর্পণ করেছেন। ৩ মার্চ ১৪ জন এবং বাকি ১৬ জন ৪ মার্চ আত্মসমর্পণ করেছেন।
আসামিরা ওই আইনজীবীর বিরুদ্ধে বার কাউন্সিলেও একটি আবেদন করেছেন বলেও তিনি জানান।
আদালত বলে, ‘আপনি বলছেন আত্মসমর্পণ কিন্তু পুলিশ রিপোর্টে বলছে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
এরপর আদালত বলে, ‘আপনি কে?’
এর জবাবে আইনজীবী বলেন, ‘তারা (আসামিরা) আমাকে ওকালতনামা দিয়েছেন। আমি তাদের পক্ষে।’
পরে আদালত বলে, ‘আপনি যথাযথ প্রক্রিয়ায় আসেন।’
একটি মামলায় ভুয়া আগাম জামিননামা তৈরির ঘটনায় বগুড়া সদর উপজেলার যুবলীগ নেতা আমিনুর ইসলাম, আব্দুল আলিম, আনোয়ার মণ্ডলসহ ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করতে ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।
৭ দিনের মধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করতে বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেয়া হয়।
বিষয়টি তদন্ত করতে বগুড়ার মুখ্য বিচারিক হাকিমকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
এ মামলার বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের নাম উল্লেখ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি জামিন পেয়েছেন আমিনুর ইসলামসহ ৩০ আসামি। কিন্তু ওই দিন এই কোর্ট থেকে এমন কোনো জামিনাদেশ হয়নি। এমনকি সেখানে আইনজীবীদের যে নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেটির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ঘটনার বিবরণ থেকে জানা গেছে, গত ৯ ফেব্রুয়ারি বগুড়ায় মোটর মালিক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ১০ ফেব্রুয়ারি পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে তিনটি পাল্টাপাল্টি মামলা হয়।
এর মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহনের ছোট ভাই মশিউল আলম দীপন যুবলীগ নেতা আমিনুর ইসলামকে প্রধান করে ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। এ মামলায় জামিন জালিয়াতির ঘটনা ঘটে।