প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে পলাতক প্রশান্ত কুমার হালদারের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় দায়ী কে তা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে হাইকোর্টের শুনানিতে।
ইমিগ্রেশন পুলিশ বলছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের চিঠি হাতে পাওয়ার দুই ঘণ্টা আগেই দেশ ছেড়েছেন এই ব্যাংকার।
তবে দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, তার দেশ ত্যাগের কয়েক ঘণ্টা আগেই তাদের চিঠি ইমিগ্রেশন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক রিসিভ করেছেন। এমনকি ওয়াটস অ্যাপেও পাঠানো হয়েছে।
সোমবার বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি তথ্য দেন।
আদালতে দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। ইমিগ্রেশন পুলিশের পক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। বাংলাদেশে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তানজীব-উল আলম ও খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ।
পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ থাকার পরও পি কে হালদার কীভাবে দেশ থেকে পালিয়েছেন, তা জানতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আদেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।
ওই আদেশের পর ইমিগ্রেশন পুলিশের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর বিকাল পৌনে ৪টায় যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পিকে হালদার দেশ ত্যাগ করেছেন। সেদিন ইমিগ্রেশন পুলিশের ৫৯ জন সদস্য বেনাপোল স্থলবন্দরে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
চিঠি পাঠানোর আগে দুদক যদি ২৩ অক্টোবর সকালে টেলিফোন ইমিগ্রেশন পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করত। তাহলে পিকে হালদারের পালানোর পথটা হয়ত বন্ধ করা যেত।
পিকে হালদারের দেশ ত্যাগে ইমিগ্রেশণ পুলিশের কোনো ব্যর্থতা বা গাফিলতি ছিল না উল্লেখ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘পিকে হালদারের পালিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত দুদকের চিঠি তারা পেয়েছে পিকে হালদার পালিয়ে যাওয়ার পরে।’
তিনি বলেন, পি কে হালদার যাতে দেশত্যাগ করতে না পরেন, সে জন্য ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) চিঠি দেয় অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশন –দুদক। ডাকযোগে পাঠানো সেই চিঠি এসবি পায় ২৩ অক্টোবর বিকেল সাড়ে চারটায়। পরে এসবি সে চিঠি দেশের সব স্থল বন্দর ও বিমান বন্দরে দায়িত্বপালনকারী ইমিগ্রেশন ইউনিটকে পাঠায়। ইমিগ্রেশন ইউনিট ওইদিন পৌনে ছয়টায় ওই চিঠি পায়। কিন্তু তার ঘণ্টা দুই আগে বিকেল তিনটা ৩৮ মিনিটে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পি কে হালদার দেশ ছেড়ে যান।
তবে দুদকের পক্ষের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আদালতকে বলেন, পিকে হালদারের দেশ ত্যাগে দুদকের কোন গাফিলতি ছিল না।
তিনি বলেন, ‘দুদকের লিখিত কপিটা অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক রিসিভ করেছেন ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে। সেটা আরও কনফার্ম করতে সেই চিঠিটা হোয়াটস অ্যাপে পাঠানো হয় ২টা ৪৩ মিনিটে। সেটা যে তারা রিসিভ করেছে সেটিও দুদকের কাছে আছে। সুতরাং দুর্নীতি দমন কমিশনের এখানে কোনো অবহেলা ছিল না।’
এক পর্যায়ে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বাহাস হয়।
পরে আদালত বলে, ‘আমরা দেখব কারা আসলে দোষী। সেটি বের করতে হবে।’
আগামী ৬ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির জন্য রাখা হয়েছে বলে জানান আইন কর্মকর্তা আমিন উদ্দিন মানিক।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) সাবেক পরিচালক পি কে হালদার বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে।
চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এ ঘটনায় দুদকের করা মামলায় বলা হয়, রিলায়েন্স ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকার সময়ে আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে ৩৯টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন পি কে হালদার। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে থাকা ৮৩ জনের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কৌশলে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি ও তার সহযোগীরা।
চলতি বছরের শুরুতে পি কে হালদারের কানাডা পালিয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। এরপর তার পাসপোর্ট, সম্পত্তি জব্দ করা হয়। আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে অপসারণও করা হয়।
পাচার টাকা উদ্ধারে ‘সহযোগিতার জন্য’ ২৫ অক্টোবর নিরাপদে দেশে ফেরার নির্দেশনা পেতে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন হালদার।
তবে ২১ অক্টোবর হাইকোর্ট হালদারকে দেশে আসার অনুমতি দিলেও ফেরার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়। এরপর দেশে না আসার কথা জানিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল খালেক খানকে চিঠি দেন তিনি।
দুদক এরই মধ্যে পি কে হালদারের বেশ কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের ব্যাংক হিসাবে থাকা দেড় হাজার কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে।
ঢাকা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে পি কে হালদারের বিপুল পরিমাণ জমি জব্দ করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে একটি ১০ তলা ভবনও।
দুদক জানতে পেরেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা আত্মসাত করে জমি কিনতেন পি কে।