বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখে বঙ্গবন্ধুর আত্মা ‘নিশ্চয়ই খুশি হচ্ছেন’ বলে মন্তব্য করেছেন তার বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেন তিনি।
নিজস্ব অর্থায়নে এটিই দেশের প্রথম বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল। এ তহবিল থেকে প্রথম অর্থায়ন পেয়েছে পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ও মেইনটেনেন্স ড্রেজিং প্রকল্প।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু আমি জানি, বাংলাদেশকে তিনি এতই গভীরভাবে ভালোবেসেছেন, আর তার পাশে ছিলেন সব সময় আমার মা। তাদের আত্মাও নিশ্চয়ই খুশি হবে এটা দেখে যে বাংলাদেশ আজ নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে।
‘শুধু উন্নয়নশীল দেশ না, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে অবকাঠামো উন্নয়ন করার সক্ষমতা অর্জন করেছি।’
নানা নেতিবাচক মন্তব্যের পরও পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের চট্টগ্রাম পোর্টে সক্ষমতা বৃদ্ধির পদক্ষেপও আমরা নিয়েছি, পাশাপাশি মোংলা পোর্টও চালু হয়েছে। এ দুটো হলে অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারবে। এটাও অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
‘সত্যি কথা বলতে কি, যখন পায়রা পোর্ট করি তখন অনেকের কাছে কথা শুনতে হয়েছে, চলবে না, এটা কীভাবে হবে, কাজে লাগবে না ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে আমি এত চিন্তা করি না। এ দেশটাকে আমি চিনি, আর দেশের উন্নয়নে চিন্তাভাবনা বাবার বড় সন্তান হিসেবে পাশে থেকে জানার সুযোগ পেয়েছি। যখন সব হারিয়ে বাংলাদেশে ফিরি একটা চিন্তা মাথায় নিয়ে। যে স্বপ্ন নিয়ে আমার বাবা এ দেশ স্বাধীন করেছেন সেটা পূরণ করতেই হবে।’
বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই প্রথম আমাদের নিজস্ব একটা বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল করে আমাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিজস্ব অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলাম। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তখন থেকেই আমাদের প্রচেষ্টা এ দেশটাকে আমরা কীভাবে উন্নত করে গড়ে তুলব।
‘প্রথমবার সরকারে আসার পর অনেক কাজই অনেক দূর এগিয়েছে। এরপর আমরা আট বছর ক্ষমতায় থাকতে পারিনি। দ্বিতীয়বার যখন সরকারে আসলাম তারপর থেকে এ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সরকারে আছি বলেই আজকে দেশে উন্নয়নটা দৃশ্যমান হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার সকালে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল উদ্বোধন করেন।
‘দেশকে চেনা মানুষকে ভালোবাসাই উন্নয়ন’
দেশকে চেনা এবং ভালোবাসা ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেন, ‘আসলে উন্নয়নটা তখনই হবে, দেশটাকে যদি কেউ চিনতে পারে, জানতে পারে। দেশের মানুষকে ভালোবাসতে পারলে এবং দেশের উন্নয়ন যে অপরিহার্য, এটা যদি কারও চিন্তা-চেতনায় থাকে, তখনই সে দেশের উন্নতি সম্ভব।
‘আমাদের সীমিত সম্পদ, জনসংখ্যা অনেক বেশি ভৌগোলিক সীমারেখার তুলনায়। এ দেশে ধারাবাহিক গণতন্ত্র চলেনি। মিলিটারি ডিক্টেটররা সময় সময়, কখনও দৃশ্যমান হয়ে কখনও অদৃশ্যমান থেকে এ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। ক্ষমতা যুদ্ধাপরাধী আর খুনিদের হাতে থাকলে সে দেশের উন্নতি সম্ভব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমরা অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব করতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি বলেই আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।’
আওয়ামী লীগ সরকারে এসেছে বলেই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ছাড়া যারা ক্ষমতায় ছিল, পঁচাত্তরের পর তাদের একটা প্রবণতাই ছিল বিদেশিদের কাছে হাত পেতে চলা। ভিক্ষা চাওয়া। নিজের মর্যাদা নিয়ে চলতে হবে বা নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, এই চিন্তাটাই তাদের মাথায় ছিল না, এটাই হলো বাস্তবতা।
‘আওয়ামী লীগ যখন সরকারে এসেছে, আওয়ামী লীগের চিন্তা হলো আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে হবে, দেশকে উন্নত করতে হবে। আর আমাদের উন্নয়নের মূল পরিকল্পনাই হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ করে একেবারে গ্রামের মানুষকেও স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা।’
তিনি বলেন, ‘আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধি যেমন অর্জন করব, সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে থাকবে যার সুফল সাধারণ মানুষ পাবে। আর উন্নয়নটা যেন সমগ্র বাংলাদেশে একেবারে সমানভাবে হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের সকল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি বলেই আজকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পেরেছি।
‘যদিও করোনা ভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিতেই প্রভাব ফেলেছে কিন্তু এর মাঝেও আমাদের নিজেদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই এ তহবিল গঠন।’
দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর উন্নয়নের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বাড়বে বলে আশাবাদী প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘রামনাবাদ চ্যানেলটা ড্রেজিং করা, এখানে যাতে আরও ড্রাফট বাড়ে, আরও জাহাজ আসতে পারে এবং পোর্টটা যাতে আরও চালু হতে পারে।
‘এর ফলে আমাদের পুরো দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব পড়ছে। সেই অঞ্চলের মানুষগুলো যারা সব সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, দুর্যোগ মোকাবিলা করেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে হতো, তাদের জীবনমান উন্নত হচ্ছে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছেই এখন উন্নয়নের রোল মডেল। অনেকেই অনেক সময় জিজ্ঞেস করে ম্যাজিকটা কী? বলি ম্যাজিকটা কিছুই না। ম্যাজিকটা হলো দেশপ্রেম। দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ। দেশের মানুষকে নিজের বলে চিন্তা করা।
‘কেউ হয়তো তার সন্তানকে দুপায়ে দাঁড় করানোর কথা চিন্তা করবে। আর আমার চিন্তা, আমার বাবার কাছে যেটা শিখেছি, দেশের মানুষকে দুপায়ে দাঁড় করানো, তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। এটাই আমার লক্ষ্য, অন্য কিছু না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এটা আরও বড় কর্তব্য আমাদের সামনে, বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। যদি সেটা আমরা করতে চাই, নিজের দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা, বাজার সম্প্রসারণ করা। দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা। বিশ্ব গ্লোবাল ভিলেজ, এখানে একা একা কেউ চলতে পারে না।
‘এই রামনাবাদ চ্যানেল শুধু ড্রেজিং করলে হবে না, প্রতিবছর মেইনটেন্যান্স করতে হবে। এভাবে আমাদের দক্ষিণের নদীগুলো যদি আমরা খুলে দিতে পারি, নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পাবে। নদীপথে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সুগম হবে। শুধু তাই না, এখান থেকে ভারতের আসাম বা ভুটান থেকে নৌপথেই পণ্য পরিবহন করার সুযোগ হবে। এই পোর্টগুলো ব্যবহার করা যাবে। এর ফলে আমাদের অর্থনীতি আরও মজবুত হবে।’
এ সময় করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্বও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের মধ্যে সকলেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে চলবেন। দ্বিতীয় ওয়েভটা কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে সবাই যেন স্বাস্থ্যবিধিটা মেনে চলেন, সে অনুরোধটা আমার থাকবে।
‘টিকা কর্মসূচি আমরা শুরু করেছি কিন্তু তারপরেও সবাইকে সুরক্ষাবিধি মেনে চলতে হবে।’