পিতৃত্বের দাবি করে হুলুস্থুল ফেলে দেয়া কক্সবাজারের যুবক মো. ইসহাকের করা মামলায় এবারও আদালতে হাজির হলেন না টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি।
এ নিয়ে পরপর দুইবার আদালতের আদেশ উপেক্ষা করলেন কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য।
গত ১৩ ডিসেম্বর টেকনাফের সহকারী জজ জিয়াউল হকের আদালতে মামলা করার পর বদিকে আদালতে হাজির হতে দুইবার সমন দেয়া হয়েছে। কিন্তু সাবেক সংসদ সদস্য বিচারকের মুখোমুখি হচ্ছেন না।
মামলা করার পর আদালত বদিকে ১৪ জানুয়ারি হাজির হতে সমন দেয়।
১৩ ডিসেম্বর মামলার পর আদালতের সমন নিয়ে টেকনাফে বদির বাসায় যান আদালতের জারিকারক মো. টিটো। কিন্তু ঢুকতে দেয়া হয়নি তাকে। আদালতের সমন আছে জানালে দারোয়ান বলেন, বদি ঢাকায় আছেন। এরপর টিটো ফিরে আসেন।
১৪ জানুয়ারি বদি আদালতে অনুপস্থিত থাকায় সেদিন নতুন তারিখ দেন বিচারক। ১৪ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতাকে উপস্থিত থাকতে বলে আবার সমন পাঠাতে বলেন তিনি।
- আরও পড়ুন: বদিকে বাবা দাবি করে আদালতে যুবক
কিন্তু রোববার এই তারিখেও আদালতে এলেন না আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য।
বিষয়টি আদালতের নজরে আনার পর সমনটি এবার বদির বাড়ির পাশাপাশি ই-মেইলেও পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক।
ইসহাকের দাবি, ৯০ দশকে তার মাকে বিয়ে করেন বদি। বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতার বাবা জানতে পারার পর তালাক না দিয়েই বিয়ে দেয়া হয় আরেকজনের সঙ্গে। তত দিনে মায়ের পেটে চলে এসেছেন ইসহাক।
বাবা দাবি করে মো. ইসহাকের করা মামলায় দ্বিতীয়বারের মতো আদালতে হাজির হলেন না আবদুর রহমান বদি
এই যুবক মামলার আর্জিতে বলেছেন, তার দাবির সত্যতা প্রমাণে তিনি ডিএনএ পরীক্ষা করাতেও রাজি।
রোববার দুপুরে আদালতে শুনানি শেষে সাংবাদিকদের ইসহাক বলেন, মামলা করায় ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, পিতৃত্ব প্রমাণ হয়ে যাওয়ার ভয়ে আদালতে আসছেন না বদি।
ইসহাক বলেন, ‘মামলার পর আদালতে জারি করা সমন বিভিন্নভাবে তার বাবা আব্দুর রহমান বদির কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তিনি তা পাননি বলে দাবি করছেন। এটি তার একটি কৌশল। তিনি এভাবে মূলত আদালতে সময়ক্ষেপণ করছেন।’
মামলার পর বিভিন্নভাবে তাকে হুমকি দেয়ার অভিযোগ করে ইসহাক বলেন, ‘সুযোগ বুঝে তিনি আমাকে মেরে ফেলার চিন্তা করছেন। তবে আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত পিতার স্বীকৃতি আদায় করেই ছাড়ব।’
ইসহাকের আইনজীবী কফিল উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বদি আজও আসেননি। কিন্তু কতদিন এভাবে থাকবেন। এবার তাকে ই-মেইলের মাধ্যমে কপি পাঠানো হবে।’
আইনজীবী কফিলউদ্দিন বলছেন, ইসহাকের চেহারা বদির মতো, আর এটাই তার দাবির সত্যতার প্রমাণ
বদির সঙ্গে ইসহাকের চেহারায় মিল থাকা নিয়ে স্থানীয়ভাবে নানা আলোচনা আছে। ইসহাকের আইনজীবী কফিল উদ্দিন এই বিষয়টিই সামনে আনছেন।
ইসহাক যা বলছেন
ইসহাকের দাবি, ১৯৯২ সালের ৫ এপ্রিল তার মা সুফিয়া খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বদির। বিয়ে পড়ান বদিদের আবাসিক হোটেল নিরিবিলিতে কর্মরত মৌলভী আবদুস সালাম। সাক্ষী ছিলেন হোটেলের দারোয়ান মোহাম্মদ এখলাছ।
বিষয়টি নিয়ে এতদিন চুপ থাকা প্রসঙ্গে ইসহাক জানান, বদির রাজনৈতিক শত্রু ও সামাজিক অবস্থানসহ নানা সমীকরণের কারণে তিনি মায়ের কাছে সময় নেন।
আর্থিক কষ্টে থাকলেও বদিকে উদ্দেশ করে ইসহাক বলেন, ‘আপনার ছেলে হিসেবে অনুরোধ করছি, আমি আপনার টাকাপয়সা সম্পত্তি কিছু চাই না। আমি শুধু আপনাকে চাই।’
- আরও পড়ুন: ‘টাকাপয়সা নয়, বাবা বদিকে চাই’
‘আপনি আপনার ছেলেমেয়েকে যেভাবে আদর-স্নেহ দিয়ে পিতার পরিচয় দিচ্ছেন, আমিও সেই অধিকার চাই।’
পিতৃপরিচয় পাওয়া ছাড়া আদালতে যাওয়ার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই জানিয়ে ইসহাক বলেন, ‘আমি আদালতে গেছি সুষ্ঠু বিচারের আশায়। আমি আশা করি, বাবা আমাকে গ্রহণ করবেন। আমি বাবার সম্মানহানি করতে চাইনি।’
তিনি বলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে আমার বাবা আবদুর রহমান বদিকে বলতে চাই, আপনি সত্য বলতে কখনও মাথা নত করেন না। আপনি হয়তো কোনো চাপে পড়ে আমাকে অস্বীকার করছেন।’
যা বলছেন ইসহাকের মা
নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয়েছে ইসহাকের মা সুফিয়া খাতুনের। তিনি জানান, ১৯৯২ সালের জানুয়ারির দিকে তারা টেকনাফ ইউনিয়নের অলিয়াবাদে থাকতেন। তার বাবা থাকতেন সৌদি আরবে। সে সময় বেশ কয়েকবার ডাকাতি হয়।
টেকনাফ তখন ইউনিয়ন পরিষদ। আর এর চেয়ারম্যান বদির বাবা এজহার মিয়া। বিষয়টি তাকে জানালে বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার আশ্বাস দিয়ে সুফিয়াদের ঘরবাড়ি বিক্রি করে দেয়ার পরামর্শ দেন এজহার। তারাও চেয়ারম্যানের কথামতো বাড়িঘর বিক্রি করে দেন।
বদিদের বাড়িতে সালিশ চলত, এমন একটি পরিত্যক্ত ঘরে আশ্রয় হয় সুফিয়াদের।
মামলার বাদী ইসহাকের মা সুফিয়া খাতুন, যিনি দাবি করেছেন ১৯৯২ সালে বদি তাকে বিয়ে করেছেন
সুফিয়া জানান, বদির সঙ্গে তার দেখা হতো, কথা হতো। একপর্যায়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। রাজি হয়ে যান তিনিও।
১৯৯২ সালে ৫ এপ্রিল ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে বিয়ে হয়। বিয়ে পড়ান আবদুর রহমান বদির পারিবারিক আবাসিক হোটেল নিরিবিলির মৌলভী আবদুস সালাম। সাক্ষী ছিলেন হোটেলের দারোয়ান এখলাছ।
- আরও পড়ুন: বোন পরিচয়ে বিয়ে দেন বদি: ইসহাকের মা
এই কথা জানতেন না বদির বাবা এজহার মিয়া। যখন কানে আসে, তখন গর্ভে সন্তান ইসহাক নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছে।
সুফিয়া জানান, বাবা এজহারের রাগ দেখে বদি সে সময় গর্ভপাত করার চেষ্টা করেন। তিনি রাজি না হওয়ায় গর্ভের সন্তানসহ হত্যার হুমকি দেন। পরে রাজমিস্ত্রিকে বিয়ে করতে বাধ্য করেন বদি ও এজহার।
সুফিয়া জানান, তিনি যে গর্ভবতী, সেটি জানতেন না রাজমিস্ত্রি নুরুল।
সুফিয়ার ভাষায়, ‘আর আব্বা ইত্তে সৌদি আরব আইসিল। আরও ঘরত প্রায়ই ডাহাইত অক্কলে ডাহাতি অয়ত নিরাপত্তার লাই আরে এমপির বাপ এজেহার কোম্পানি ইতার ঘরর এক্কান বারান্দা আইসসিল এড়ে আশ্রায় লই। এড়ে থাকা অবস্থাত গোপনে বদি সাহেব আরে ১৯৯২ সালে ৫ এপ্রিল বিয়া ঘরে।
‘বিয়া পড়ায় বদি সাহেবর হোটেল নিরিবিলি, বিয়া পড়ায়ে মৌলভি আবদুস সালাম বিয়াত সাক্ষী আইসসিল হোটলর দারোয়ান এখলাছ।’
তিনি বলেন, ‘বিয়ার হতা ইয়ান ইতার ঘরর আত্মীয়-স্বজন অক্কলে জানাজানি হয়। এত্তে প্রথমে বদি সন্তান নষ্ট গইত্ত চাইল। আই রাজি নয়লে এত্তে ইসহাক আর ছয় মাসর পেটত। ইতার মানুষ অক্কলে আরে জোরগরি ইতারত এত্তে রাজমিস্ত্রি হাজ গইত্ত নুরুল ইসলাম ইবারে বোন পরিচয় দিয়রে আরে বিয়া দেয়।’
সুফিয়া এখন তার ছেলে ইসহাকের পিতৃপরিচয় চান। তার কোনো দাবি-দাওয়া নেই জানিয়ে ইসহাককে ছেলে হিসেবে মেনে নেয়ার জন্য বদির প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
নুরুল যা বলছেন
সুফিয়ার বিয়ে হয়েছিল যার সঙ্গে, সেই নুরুল ইসলাম বলেন, বদির বাবা এজহার মিয়া একদিন তাকে ডেকে বললেন, ‘তোর জন্য একটা মেয়ে ঠিক করেছি।’
তখন না করেননি নুরুল।
বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন বদিও। তিনিও সুফিয়াকে চাচাতো বোন পরিচয় দেন। বলেন, সব সময় পাশে থাকবেন।
মাকে নিয়ে কক্সবাজারের এই বাড়িতে থাকেন বদিকে বাবা দাবি করা যুবক মো. ইসহাক
তবে বিয়ের দুই মাস পর নুরুল জানতে পারেন তার স্ত্রী গর্ভবতী। তখন সুফিয়া তাকে সব খুলে বলেন। পরে বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন সুফিয়া।
নুরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, এমন বাস্তবতা সামনে আসবে তা কখনও কল্পনাও করেননি তিনি। কখনও কক্সবাজারে কখনও চট্টগ্রামে পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াতেও হয়েছে তাকে।
নুরুলও চান, সন্তান হিসেবে ইসহাককে স্বীকৃতি দিক বদি।
বদির বিরুদ্ধে আরও যত মামলা-অভিযোগ
বদি নানা ঘটনায় বাংলাদেশে আলোচিত চরিত্র। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম সংসদ নির্বাচনে তিনি কক্সবাজার-৪ আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য হন। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে তার বদলে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় তার স্ত্রী শাহিন চৌধুরীকে। তিনিই এখন ওই আসনের সংসদ সদস্য। তবে নেপথ্যে থেকে কাজ করেন বদি।
এই রাজনীতিক আলোচিত ইয়াবা পাচারের অভিযোগ নিয়ে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির প্রতিবেদনে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারের কারবারে তার সম্পৃক্ততার তথ্য আছে বলে জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিবেদন এসেছে একাধিক। তবে বদি বরাবর এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর বদিকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ জজ আবু আহমেদ জমাদার।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার পর ওই বছরের ২০ নভেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।
হাইকোর্টে এই মামলার শুনানি হয়নি এখনও।