ফাঁদ পেতে বিয়ে করে প্রবাসী এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কোটি টাকারও বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মামলায় গ্রেপ্তার মডেল-অভিনেত্রী রোমানা ইসলাম স্বর্ণার বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ তোলা হয়েছে।
মোহাম্মদপুর থানায় তার স্বামী সৌদি প্রবাসী কামরুল হাসানের করা মামলায় স্বর্ণাকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মৃত্যুঞ্জয় দে সজল জানান, কামরুল হাসান মামলায় উল্লেখ করেন, প্রতারণার মাধ্যমে বিয়ে করে তার কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন স্বর্ণা।
এজাহারে বলা হয়, কামরুল ২০০৪ সালে সৌদি আরবে গিয়ে ২০০৫ সাল থেকে ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে তিনি মক্কায় নাবিয়াহ আল-মদিনা ইলেকট্রো-মেকানিক্যালি কোম্পানি নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি ঢাকার মিরপুরে কে এম ফুয়েল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তিনি।
কামরুল বলেন, ‘২০১৮ সালে স্বর্ণার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। স্বর্ণা নিজেকে চিত্রনায়িকা পরিচয় দেন। পরিচয়ের শুরুতে স্বর্ণা জানান, তার স্বামী মারা গেছেন। তার এক সন্তান রয়েছে। তখন তার সঙ্গে স্বর্ণার ফেসবুকে যোগাযোগ হতো। পরিচয়ের পর থেকেই তিনি নানা অজুহাতে টাকা চাইতেন।
এজাহারে বলা হয়েছে, দেশের রাজনৈতিক মহলসহ বিভিন্ন গুরুত্বর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ আছে দাবি করে কামরুলের ব্যবসায় সহযোগিতার কথা বলে ঘনিষ্ঠ হন স্বর্ণা। একপর্যায়ে তার ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাতে কামরুলের সহযোগিতা চান স্বর্ণা।
রোমানা ইসলাম স্বর্ণা
কামরুলকে স্বর্ণা বলেন, উবারে চালানোর জন্য একটি গাড়ি কেনার লোন দিতে। যার বিনিময়ে প্রতিমাসে লভ্যাংশ প্রদান করবেন। কামরুল তখন স্বর্ণাকে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন।
এরপরই আবার ব্যবসার উদ্দেশ্যে কম দামে একটি ফ্ল্যাট কেনার প্রস্তাব দেন স্বর্ণা। তখন আবার স্বর্ণাকে ৬৬ লাখ টাকা দেন কামরুল। এ ছাড়া নানা অজুহাতে স্বর্ণা কামরুলের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।
২০১৯ সালের ১০ মার্চ সৌদি থেকে দেশে আসেন কামরুল। এর তিন দিনের মাথায় ১৩ মার্চ স্বর্ণা উবারে ভাড়ায়চালিত প্রাইভেট কার ও ফ্ল্যাট দেখার জন্য মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ার বাসায় ডাকেন।
মামলায় কামরুল বলেন, ‘১৪ মার্চ আমি ওই বাসায় যাই। সেখানে অজ্ঞাত এক যুবক ছিলেন। তখন স্বর্ণা নাশতা দেয়। নাশতা খেয়ে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। এর একপর্যায়ে আমি নিজেকে ওই ফ্ল্যাটে উলঙ্গ অবস্থায় আবিষ্কার করি। তখন আমি চিৎকার শুরু করলে রুমে স্বর্ণা, তার ভাই নাহিদ হাসান ও অজ্ঞাত এক যুবক প্রবেশ করে।
‘এর মধ্যে স্বর্ণা আমার সঙ্গে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় দুই-তিনটা ছবি দেখিয়ে বলে, চিল্লাচিল্লি করবি না। গাড়ি ও ফ্ল্যাট বাবদ যে টাকা দিছিস তা ভুলে যা। আমাকে বিয়ে করতে হবে তোকে। না হলে সৌদি আরব ও বাংলাদেশে তোর পরিচিত যত মানুষ আছে সবাইকে এই ছবি দেখিয়ে মানসম্মান নষ্ট করব। তাছাড়া তোর নামে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা করব।’
এজাহারে কামরুল বলেন, ‘স্বর্ণার মা আশরাফী আক্তার শেইলী ও তার ছেলে জান্নামী ইউসুফ আলাল স্ট্যাম্প ও কলম হাতে রুমে প্রবেশ করে আমাকে তাতে স্বাক্ষর দিতে বলে। আমি স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমার মোবাইলের বিভিন্ন নম্বরে ফোন করে স্বর্ণাকে ধর্ষণ করেছি বলে জানানোর হুমকি দেয়। নাহিদ হাসান জেমি ও সেই অজ্ঞাত যুবক হত্যার উদ্দেশ্যে আমাকে কিল-ঘুষি মারতে থাকে। আমি মানসম্মান ও প্রাণভয়ে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করি।
‘উপস্থিত সবাই হুমকি দেয় আমি সাত দিনের মধ্যে স্বর্ণাকে বিয়ে না করলে মিথ্যা মামলার পাশাপাশি মানসম্মান নষ্ট করার জন্য যা যা করা দরকার তারা সব করবে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে অমাৱ ড্রাইভারের সহায়তায় বাসায় ফিরি।’
কামরুল জানান, বিষয়টি প্রথমে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নিলেও সামাজিক মর্যাদা ও মানসম্মানের ভয়ে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। বলেন, ‘ক্রমাগত হুমকির মুখে ২০ মার্চ নিকাহনামা রেজিস্ট্রির মাধ্যমে আমি তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে বাধ্য হই। নিকাহনামায় সে নিজেকে বিধবা হিসেবে উপস্থাপন করে।’
স্বর্ণার নির্দেশনায় দেনমোহর বাবদ নগদ ১০ লাখ টাকা পরিশোধের পাশাপাশি তার চাহিদামতো ৩৩ ভরি স্বর্ণ দিতে বাধ্য হন বলে জানান কামরুল।
প্রবাসী এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি তার বাসায় কয়েক দিন অবস্থান করতে বাধ্য হই এবং ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল সৌদি আরবে চলে যাই। সৌদি আরবে যাওয়ার পর প্রথম দিকে সে আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে এবং আমি তাকে নিয়মিত সাংসারিক খরচ প্রদান করেছি।
‘চার-পাঁচ মাস পর সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে এসে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে সে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে থাকে এবং দেখা করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ বিষয়ে আমি তার পরিবারের সঙ্গে কথা বললে তারাও আমাকে ভয়ভীতি ও হুমকি দেয়। স্বর্ণার আচরণ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাকে ফ্ল্যাট ও গাড়ি বুঝিয়ে দিতে বললে সেসব নেই বলে জানায়।’
২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি আদালতে মামলা করেন কামরুল। মামলার পর স্বর্ণা টাকা, অলংকার, ফ্ল্যাট ও গাড়ি ফেরত দিতে চাইলে মামলা প্রত্যাহার করে সৌদি আরব ফিরে যান তিনি। চলতি বছর ১২ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরব থেকে কামরুল বাংলাদেশে এসে ফোন করলে লালমাটিয়ার বাসায় যেতে নিষেধ করেন স্বর্ণা।
কামরুল বলেন, ‘১৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে তাকে ফোন করলে সে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে থাকে। মোহাম্মদপুর থানার এসআই সাইফুল ইসলাম ও ফোর্সসহ রাত অনুমান ৩টার দিকে ওই বাসায় যাই। বাসার সিকিউরিটি জানায়, রাত আনুমানিক ২টা ৪০ মিনিটে স্বর্ণা বাসায় ফিরেছে।
‘আমি পুলিশ নিয়ে তার ফ্ল্যাটের সামনে যাই। সে দরজা না খুলে মোবাইলে এসআই সাইফুল ইসলামকে জানায় ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর সে আমাকে তালাক দিয়েছে। পরে এসআই সাইফুল ইসলাম তালাকের কপি আমার হোয়াটসঅ্যাপ আইডিতে পাঠান। আমি তালাকের কপিটি যাচাইয়ের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন অফিসে আবেদন করে জানতে পারি, নোটিশটি জাল।’