তিন নিরাপত্তাকর্মীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বহুতল ভবনের এক অফিসে প্রবেশ করেন দুইজন। সেখান থেকে চুরি করেন ৬৫ লাখ টাকা। পরে চারজন সেই টাকা ভাগাভাগি করে নেন। টাকার ভাগ পেয়ে তিনজন কেনেন মোটরসাইকেল। তাদের একজন ১০ লাখ টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করেন স্ত্রীর নামে। আরেকজন সেই ভাগের টাকায় করেছেন বিয়ে।
কিন্তু তাদের কেউই খুব বেশি দিন চালাতে পারলেন না চুরির টাকায় কেনা মোটরসাইকেল; করতে পারলেন না নতুন সংসার। গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন চক্রের প্রধানসহ তিনজন। ধরা পড়েছেন চক্রের প্রধানের স্ত্রীও, যার নামে ১০ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করা হয়।
চুরির এই ঘটনা ঘটেছে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বনানীর ১৩ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বর ভবনের ‘হালাল’ বডি স্প্রেসহ প্রসাধন সামগ্রী বিপণন প্রতিষ্ঠান লাফ্জ ইন্টারন্যাশনালের অফিসে।
ঘটনার রাতে ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন তিন কর্মী। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরেরা রাতে অফিসে ঢুকে চুরি করে পালিয়ে যায়। চুরির ঘটনা ধরা পড়ে ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরায়। সেই ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হয় তিন জনকে।
বুধবার রাজধানী ঢাকা ও নেত্রকোণায় অভিযান চালিয়ে ওই চারজনকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ। উদ্ধার করা হয় চুরি যাওয়া ৩৯ লাখ টাকা ও চুরির টাকায় কেনা তিনটি মোটরসাইকেল।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মো. রহিম, সোহেল খাঁ ওরফে কালা সোহেল, সোহেল এবং রহিমের স্ত্রী রাশিদা আক্তার।
গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ভাষ্যমতে, জিজ্ঞাসাবাদে তারা ৬৫ লাখ টাকা ভাগাভাগি করে নেয়ার কথাও স্বীকার করেছেন। ভাগাভাগিতে ২৮ লাখ টাকা নেন রহিম, ২৮ লাখ নেন সোহেল খাঁ, ৪ লাখ নেন সোহেল এবং সোহেল খাঁর বোনের স্বামী সেলিম নেন ২ লাখ টাকা। বাকি টাকা বিভিন্নভাবে খরচ হয়।
ডিবি গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম সাকলায়েন জানান, চক্রটি দিনের বেলা ও রাতে গুলশান-বনানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে অফিস ও বাসা রেকি করে। ঘটনার দিন রাত ১০টা থেকে রহিম, সোহেল খাঁ ও সোহেল বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বাসা এবং অফিস রেকি করেন। পরে বনানীর ১৩ নম্বার সড়কের ওই ভবনের নিরাপত্তার দুর্বলতা খুঁজে পান এবং সেখানে চুরির সিদ্ধান্ত নেন। রাত ৩টা থেকে সাড়ে ৩টা সময়ে তারা ভবনের পেছন দিকের গাছ বেয়ে লাফজের অফিসে ঢোকেন।
চুরির টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে চারজনকে। ছবি: নিউজবাংলা
চুরির পরদিন সকালে তারা মহাখালীর সাততলা বস্তি সংলগ্ন একটি মাঠে বসে টাকা ভাগাভাগি করেন। টাকা নিয়ে যে যার মতো চলে যান। চক্রের প্রধান রহিম যান শ্বশুড়বাড়ি শেরপুরে। সেখানে গিয়ে স্ত্রী রাশিদার নামে ১০ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করেন তিনি। বিভিন্ন কাজে খরচ করেন দুই লাখ টাকা।
রহিম ঢাকায় ফিরে দুই লাখ ১৩ হাজার টাকায় কিনেন নতুন মোটরসাইকেল। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে সাত লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। নতুন মোটরসাইকেলটিও জব্দ করা হয়েছে।
রহিম শুরুতে চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় একটি গার্মেন্টসে আয়রনম্যান হিসেবে কাজ করতেন। গত ২-৩ বছর হলো রিকশা চালাচ্ছিলেন।
ভাগের টাকা পেয়ে দুলাভাই সেলিমসহ নেত্রকোণার পূর্বধলায় গ্রামের বাড়িতে যান সোহেল খাঁ। সেখানে এক লাখ টাকায় একটি মোটরসাইকেল কেনেন। জুয়া খেলে হারেন ৪ লাখ টাকা। বাকি ২২ লাখ টাকাসহ পূর্বধলা থেকে সোহেল খাঁকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। তার মোটরসাইকেলটিও জব্দ করা হয়েছে।
ডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সোহেল খাঁ কর্মজীবনের শুরুতে মহাখালী-বনানীর বিভিন্ন সিগন্যালে ফুল, ট্যাটু ও স্টিকার বিক্রি করতেন। এরপর বনানীতে রিকশা চালানো শুরু করেন। আর তখনই পরিচয় হয় সিকিউরিটি গার্ড সোহেলের সঙ্গে। এরপর এক পর্যায়ে রহিম, সোহেল খাঁ ও সোহেল একই এলাকায় বসবাস শুরু করেন।
নিজের ভাগের চার লাখ টাকা পেয়ে একটি নতুন মোটরসাইকেল কেনন মো. সোহেল; বিয়েও করেন সেই টাকায়।
সোহেল আড়াই লাখ টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কেনেন। এরপর রহিমের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা ধার নিয়ে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ করে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেন। তিনি গত ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বনানী এলাকায় সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চাকরিতে থাকা অবস্থায় রহিমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
চুরির টাকার সরাসরি ভাগ পেয়েছেন চারজন, তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনজন এবং তাদের একজনের স্ত্রী।
ভাগাভাগির ২ লাখ টাকা পাওয়া সেলিমের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিবি কর্মকর্তা বলেন, ‘চুরির ৬৫ লাখ নিয়ে বাসায় ফেরার পথে সোহেল খাঁর বোনের স্বামী সেলিমের সহায়তা নেন তারা। এ জন্য তাকে দুই লাখ টাকা দেয়া হয়।’
সেলিমকেও খোঁজা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবাসিক ও অফিস এলাকায় সিকিউরিটি গার্ডরা যথাযথভাবে কাজ করছেন কি না- তা আরও বেশি তদারকির পরামর্শ দিয়েছেন ডিবি গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তারক্ষীরা ঠিকমতো কাজ করছেন কি না, তা ভালোভাবে তদারকি করা প্রয়োজন।’
এ ধরনের ঘটনা এড়াতে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান ও ভবনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভালো মানের সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের পরামর্শও দিয়েছেন এই কর্মকর্তা।