দীর্ঘদিনের অবসরে এক দশকের ব্যস্ত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। গণমাধ্যমের ডামাডোল-হইচইয়ে একসময় অভ্যস্ত এই প্রবীণ রাজনীতিক অনেকদিন ধরেই নেই বুম-মাইক্রোফোন-ক্যামেরা-ফ্ল্যাশের জগতে। সেই তিনিই ৭ মার্চের অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি সরব হলেন সহোদর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের অনুরোধে।
রোববার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত ‘ঐতিহাসিক সাতই মার্চ এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের অভিযাত্রা’ শীর্ষক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সাবেক এই আমলা ও মন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক সূচক একই সময়ে জোরালো সমর্থন পেয়েছে মানবিক সূচকের। মানব উন্নয়ন সূচকেও আমাদের অগ্রগতি বিস্ময়কর। যদিও আমরা এখনও মাঝ পর্যায়ে আছি। আমরা এখনও শ্রীলঙ্কা থেকে পিছিয়ে। এখানে আমাদের অধিক মনোযোগ দেয়া দরকার।’
বক্তৃতায় তিনি স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের ক্রম উন্নতির বিভিন্ন খণ্ড চিত্র তুলে ধরেন। তিনি ক্ষুধা, পুষ্টি, মানবিকতা, রপ্তানি, কৃষি ও বাজেটের অগ্রগতির ধাপগুলোর বর্ণনা দেন।
আমলাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এক মর্মস্পর্শী বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘একসময় বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ সফরের সময় আমার কোলেই একটি শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। তার মৃত্যু হয়েছিল ক্ষুধায়। ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার ওই শিশুকে জাউ খাওয়াতে চাইলেও সে খেতে পারেনি। আমার কোলেই শিশুটির মারা গিয়েছিল। আমি তার নিথর শরীর কোলে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম।’
এমন নানা অভিজ্ঞতা, ঘাত-প্রতিঘাতের শিক্ষা তিনি তার ১০ বছরের অর্থমন্ত্রিত্বকালে কাজে লাগিয়েছেন বলে জানান।
মুহিত বলেন, ‘টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালনের শুরুর বছর যে বাজেট আমি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দিয়েছিলাম, ১০ বছর পর বিদায়ের বছরে তার আকার পাঁচ গুণ বেড়েছিল। আমি সব সময়ই এটাকে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করেছি। কারণ মানুষের জন্য কাজ করার বড় নির্দেশক হিসাবে কাজ করে এই বাজেট। যেটাকে আমরা ওই সময়েই ৫০০ শতাংশ বাড়াতে পেরেছিলাম।’
বিগত ৫০ বছরে দেশের খাতভিত্তিক বিপ্লবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি সার ও লোহা প্রভৃতি শিল্প খাতে ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। আমরা খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পেরেছি। দারিদ্র্যের সীমা ৭০ ভাগ থেকে ২২ শতাংশে নামাতে পেরেছি। অতি দরিদ্রের হারও নেমে এসেছে মাত্র ১০ শতাংশে।
তিন মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজারের এখনকার আকার ৪০ বিলিয়ন ডলার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রপ্তানি খাত বিকাশে পোশাক খাত নেতৃত্বের আসনে থেকে এ খাতে বাংলাদেশ বিশ্বের এক নম্বর হয়ে ওঠার লড়াইয়ে আছে। অন্যান্য রপ্তানি খাতেও বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে। কেবল তৈরি পোশাক নয়, ওষুধ এখন আমাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানিপণ্য। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে (১৮৬) আমরা ওষুধ রপ্তানি করি। এমনকি সবচেয়ে কঠিন ওষুধ প্রশাসনের দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও আমরা রপ্তানির অনুমতি পেয়েছি।
দেশের অর্থ-বাণিজ্যের এই উল্লম্ফনের মূলে শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপ উল্লেখ করে সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে উন্মুক্ত সীমান্তনীতি নেয়ার কারণেই বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে। যদিও বিএনপিসহ অন্যান্য দল শুরুতে বিরোধিতা করেছিল, পরে তারাও বিষয়টি মেনে নেয় এবং বুঝতে পারে উন্মুক্ত সীমান্ত হলে আমাদের জন্য বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে আমরা আশপাশের ছয়টি দেশে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করতে পারি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা কেবলই শুরুর দিকে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নদীপথগুলো সচল করার মাধ্যমে বাণিজ্যের সুযোগ বিপুল পরিমাণে বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার আধুনিক প্রযুক্তিকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির কাজে লাগিয়েছে।’
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নতি ও বিনিয়োগের সুযোগ বিদেশের মাটিতে তুলে ধরতে বাংলাদেশ মিশনগুলোকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে।’
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। ছবি: নিউজবাংলা
মিশনপ্রধানদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিনিয়োগের যে সহায়ক পরিবেশ আছে, তার প্রচার অনেক সময় ঠিকমতো হয় না। আপনাদের দায়িত্ব হবে বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা, জনগণ ও বাংলাদেশি বংশধরদের সঙ্গে মিলে জানান দেয়া— বাংলাদেশ হচ্ছে সম্ভাবনার দেশ।’
তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেটে বাংলাদেশের শ্রমিক বলতে একজন নারী ইট ভাঙছে এবং তার পাশে শিশু। কিন্তু এই অবস্থা তো এখন আর নেই। বিশ্বে পরিবেশবান্ধব তৈরি পোশাক কারখানার মধ্যে সাতটি বাংলাদেশের। কিন্তু দুঃখ লাগে সেই ছবি আমি দেখি না। কৃষি যখন দেখায়, তখন দেখায় লাঙল দিয়ে কৃষক হালচাষ করছে। অথচ আমরা এখন এই কাজকে যান্ত্রিক করেছি।’
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।