নারায়ণগঞ্জে কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাদের প্রশাসন ধরছে না বলে অভিযোগ করেছেন তার বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি।
ত্বকী হত্যার আট বছর পূর্তিতে শুক্রবার নগরীর ডিআইটিতে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘কতটা পাষণ্ড হলে ত্বকীর মতো এক মেধাবী কিশোরকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। কারা, কীভাবে ত্বকীকে হত্যা করেছে, তা প্রধানমন্ত্রী জানেন। তিনি চাইলে বিচার হবে।’
সমাবেশে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, ‘এখনও র্যাব মামলার অভিযোগপত্র দেয়নি। সরকার চায় না বলে ত্বকীর বিচার হয় না। যদি প্রধানমন্ত্রী চান, তাহলে ত্বকী হত্যার বিচার হবে, অন্যথায় সম্ভব নয়।’
এ-লেভেল প্রথম পর্বের পরীক্ষায় সারা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল ত্বকী। ছবি আঁকা, কবিতা লেখা আর বই পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকত।
ত্বকী ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় রাতেই সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বাবা রফিউর রাব্বি। দুই দিন পর ৮ মার্চ নগরীর চারারগোপ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খাল থেকে ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ফাইল ছবি
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পরদিন নারায়ণগঞ্জে হরতাল ডাকা হয়। ত্বকীর বাবা অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে পুলিশ তদন্ত করলেও ত্বকীর বাবার আবেদনে উচ্চ আদালতের নির্দেশে র্যাব মামলার তদন্ত করছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জানতে চাইলে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, পুলিশ ও র্যাব ত্বকী হত্যায় জড়িত পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে ইউসুফ হোসেন লিটন ও সুলতান শওকত ভ্রমর ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
২০১৩ সালের ৭ আগস্ট শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে ও জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের ছেলে ও সাংসদ শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের কথিত সেই টর্চার সেলে অভিযান চালায় র্যাব। উদ্ধার করা হয় রক্তমাখা প্যান্ট, ধারালো অস্ত্রসহ নির্যাতনে ব্যবহার করা নানা উপকরণ।
কথিত টর্চার সেল থেকে উদ্ধার রক্তমাখা প্যান্ট। ফাইল ছবি
২০১৪ সালের ৫ মার্চ র্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছিলেন, এই দুই আসামি জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, আজমেরী ওসমানসহ ১১ জন ত্বকী হত্যায় অংশ নেন। খসড়া অভিযোগপত্রও প্রস্তুত। শিগগিরই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হবে।
কিন্তু এখনও এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দেয়নি র্যাব।
ত্বকী হত্যা মামলার আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ শুক্রবার নিউজবাংলাকে জানান, গ্রেপ্তার সালে রহমান সীমান্ত, ইউসুফ হোসের লিটন, তায়েব উদ্দিন আহম্মেদ জ্যাকি ও রিফাত বিন ওসমান আদালতে হাজিরা দেন। তবে আদালত থেকে জামিন নিয়ে সুলতান শওকত ভ্রমর বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এ মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে র্যাবের তৎপরতা নেই।
র্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ নিউজ বাংলাকে জানান, ত্বকী হত্যা একটি চাঞ্চল্যকর মামলা। এ মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়ার জন্য ঘটনার সঙ্গে জড়িত পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য তদন্ত করছে র্যাব। তদন্ত শেষে যথা সময়ে আদালতে চার্জশিট দেয়া হবে।
২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর হারুন অর রশীদ নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেয়ার পর আজমেরীকে প্রায় এক বছর দেখা যায়নি। তবে ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর হারুন বদলি হওয়ার পর তিনি আবার ফিরে আসেন নারায়ণগঞ্জে।
আজমেরী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান বলে জানিয়েছেন ত্বকী মঞ্চের সদস্য ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) মহানগর সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েল। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজমেরী গভীর রাতে শহরে বিকট শব্দে গাড়ি চালিয়ে মহড়া দেন। এটা স্থানীয়রাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও দেখে। তিনি খানপুর, জামতলা ও লিংক রোডে অবস্থান করেন। কিন্তু তাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রশাসন চাইলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
শুক্রবার সমাবেশে ত্বকীর রফিউর রাব্বি বলেন, ‘খুনের রাজনীতি নারায়ণগঞ্জে ওই ওসমান পরিবার করে। ওসমান পরিবার মনে করে, আধিপত্য বিস্তারের জন্য লাশ না ফেলে উপায় নাই। ছাত্রলীগের মিঠুকে জামতলায় দুপুরে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে আজমেরী ওসমান। এ মামলা পুলিশ নেয়নি। যখন আজমেরী ওসমানের নাম বাদ দেয়া হয় তখন মামলা নিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে না। তাই আইনকে তার নিজস্ব গতিতে আনার আন্দোলন চলবে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই নারায়ণগঞ্জে খুনিদের রাজনীতি কখন হবে না। আমরা যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের খুনের রাজনীতি করতে দেব না। এই নারায়ণগঞ্জ মানুষের নারায়ণগঞ্জ হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নারায়ণগঞ্জ হবে।’