বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়া বদলে দেবে দুই দেশের যোগাযোগ বা কানেক্টিভিটির ধরন। এই কানেক্টিভিটি হবে কেবল রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের নয়, দুই দেশের মানুষের ঘটবে সংযোগ। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই বললেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
তিনি বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্ক ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি না। যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন ৫০ বছর পার হয়ে গেছে এবং পরের ২০ বছর কী করা যেতে পারে। আমি বলব কানেক্টিভিটি।’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কানেক্টিভিটি হচ্ছে উৎপাদনশীলতা। যদি আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কানেক্টিভিটি উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে তা ঠিক রাখতে পারি, তবে এই অঞ্চলের সামগ্রিক ভূ-অর্থনীতির নতুন মিথস্ক্রিয়া ঘটবে। উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন আসবে। কারণ ভবিষ্যতের উন্নয়ন ক্ষেত্র বঙ্গোপসার ও তার পারের অঞ্চলগুলো। আর এই তত্ত্ব কেবল আমাদের কারও একপক্ষীয় বিশ্বাস নয়। আমরা যৌথভাবে দুই দেশই তা বিশ্বাস করি এবং মানি।
‘ভারত এবং বাংলাদেশ এক হলে এই অঞ্চলের অর্থনীতি ও জীবনমান পালটে ফেলা সম্ভব। আর এটা হবে কেবল বেটার কানেক্টিভিটির মাধ্যমেই।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান জয়শঙ্কর।
তিনি বলেন, ‘দুই মন্ত্রীর মধ্যে আজ বড় একটি সময়েই এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা এ ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার বিষয়েও কথা বলেছি। সম্ভাব্য দেশ হিসেবে জাপানের নাম এসেছে, কারণ ওই দেশের সঙ্গে আমাদের দুই দেশেরই সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে জাপানের সংযুক্তি প্রকল্প রয়েছে। বাংলাদেশেও তাদের ‘‘বিগ বি’' নামে প্রকল্প আছে।'
আরও পড়ুন: সীমান্তে প্রতিটি মৃত্যুই বেদনার, কষ্টের: জয়শঙ্কর
জয়শঙ্কর বলেন, ‘প্রভূত উন্নয়নে মানুষে-মানুষে যোগাযোগও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দিন শেষে দুই দেশের সম্পর্ক মানেই এক দেশের জনগণের সঙ্গে আর এক দেশের জনগণের সম্পর্ক। আমাদের উচিত মানুষকেন্দ্রিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া। আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনীতিকেও প্রাধান্য দিই এবং এটি সম্পর্কে নতুন মাত্রা ও গতি দেয়। আমার কাছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অর্থনৈতিক, কানেক্টিভিটি ও মানুষে-মানুষে যোগাযোগের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, গুরুত্ব রয়েছে।’
কেন এই সফর?
কেন এই সফর- এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সফরের অনেক কারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে মোটা দাগে বলতে পারি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর উপলক্ষে আমি এসেছি। কোভিড শুরু হওয়ার পর, এটি হবে তার প্রথম বিদেশ সফর।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক দিন দিন পালটাচ্ছে। আমাদের কিছু অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে, সেগুলো নিয়েও কথা বলতে এসেছি। সম্প্রতি আমাদের মধ্যে যে অগ্রগতি হয়েছে তারও পর্যালোচনা করেছি।’
জয়শঙ্কর বলেন, ‘আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের মাত্রা এখন এত বেশি যে, আমরা দেখিয়েছি এমন কোনো সমস্যা নেই যা আমরা আলোচনা করতে পারি না বা বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারি না। এটি সন্তুষ্টির বিষয়, কোভিড মহামারির পরেও আমাদের মিথস্ক্রিয়া এবং পরামর্শ অব্যাহত ছিল। আমরা ডিসেম্বরে ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলন করেছি, সেপ্টেম্বর মাসে যৌথ পরামর্শক কমিশন, পররাষ্ট্র, জ্বালানি ও স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক, পুলিশ প্রধানদের বৈঠক, বিএসএফ-বিজিবি আলোচনা করেছি এবং প্রতিরক্ষা সফর করেছি। আমাদের বাণিজ্য, পানিসম্পদ এবং নৌপরিবহন সচিব পর্যায়ের বৈঠক শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে। এসব বৈঠক উভয়পক্ষের প্রতিশ্রুতিই তুলে ধরে।’
হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা
সাংবাদিকদের জয়শঙ্কর বলেন, ‘নিকটতম প্রতিবেশী এবং বন্ধু হিসেবে এলডিসি থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত উত্তরণ আমাদের জন্য গর্ব ও প্রশংসার। আমরা আপনাদের অভাবনীয় আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
‘এই মহামারি (কোভিড) আমাদের বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় করে দিয়েছে। ভারতে উৎপাদিত কোভিড ভ্যাকসিনের সবচেয়ে বড় গ্রহীতা বাংলাদেশ। এ ছাড়াও বন্ধুদের মধ্যে আমাদের ভ্যাকসিনের সবচেয়ে বড় উপহারটিও (২০ লাখ) ছিল বাংলাদেশের জন্য।’
জয়শঙ্কর বলেন, ‘আমরা মাঠপর্যায়ে বাস্তব অগ্রগতি অর্জন করেছি। সাম্প্রতিক কয়েকটি উদাহরণ হলো, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আগরতলায় পরীক্ষামূলক পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনা, ত্রিপুরাকে আপনাদের জাতীয় নৌপথে সংযুক্ত করার জন্য অভ্যন্তরীণ নৌপথে দুটি নতুন প্রোটোকল রুট যুক্ত করা, ১০টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ হস্তান্তর, কনটেইনার ও পার্সেল ট্রেন চলাচল শুরু করা এবং জ্বালানি খাতে একটি যৌথ উদ্যোগ গঠন।’
তিনি বলেন, ‘মুজিব শতবর্ষ পালন, আপনাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমি বাংলাদেশের সমস্ত বন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে চাই। আপনাদের সব স্বপ্ন সত্যি হোক এবং আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি, ভারত সব সময় নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসেবে আপনাদের পাশে থাকবে।
‘এ বছরের ২৬ জানুয়ারি আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে আপনাদের অংশগ্রহণ আমাদের অভিন্ন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করে। এটি আমাদের গভীর সংহতিরও একটি অভিব্যক্তি, যা আমাদের সম্পর্ককে সর্বদা দিকনির্দেশনা দেবে।’