পাবনার রূপপুরের পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আরেকটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চায় সরকার।
বৃহস্পতিবার সকালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বিজ্ঞানী, গবেষক ও বিজ্ঞানশিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ’, এনএসটি ফেলোশিপ এবং গবেষণা-অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে এ কথা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গণভবন থেকে অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ শুরু করেছি। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এখানে প্রায় ২৪০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। প্রথমটা করা হয়েছে রূপপুরে।
‘এটা দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত একটি প্রকল্প। এর পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলে আরেকটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চিন্তাভাবনা আছে এবং সেখানে আমরা জায়গাও দেখছি, জায়গা খুঁজছি। ওই অঞ্চলটা আমরা আরও উন্নত করতে চাই।’
২০১৫ সালে রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান রোসাটমের সঙ্গে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি করে বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশন। পাবনার রূপপুরে ১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এটির নির্মাণ শেষ হলে দুটি ইউনিটে ১২০০ মেগাওয়াট করে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। সরকারের প্রাক্কলন অনুযায়ী, প্রথম ইউনিট থেকে ২০২৩ আর দ্বিতীয়টি থেকে ২০২৪ সালে বিদ্যুৎ মিলবে।
‘সব বিভাগীয় শহরে নভোথিয়েটার’
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ইতিমধ্যে দেশে হাইড্রোজেন শক্তি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জাতীয় জিন ব্যাংক স্থাপনের কাজ দ্রুত সম্পন্ন হবে। আমরা দেশের সকল বিভাগীয় শহরে নভোথিয়েটার করে দেব।
‘ঢাকায় করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আটটি বিভাগ রয়েছে; সব বিভাগে একটি করে নভোথিয়েটার করব, যাতে আমাদের শিশু থেকে শুরু করে সকলেই আমাদের বিজ্ঞানের বিষয়গুলো দেখতে পারে, জানতে পারে।’
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গবেষণায় জোর
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ছাড়া কোনো জাতি সামনে এগোতে পারে না বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারে এসে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গবেষণার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ করি।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘এই গবেষণার ফলে আপনারা জানেন যে, আমাদের খাদ্য উৎপাদন কিন্তু আমরা বৃদ্ধি করতে পেরেছি। লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান আমাদের গবেষকরা উদ্ভাবন করেছেন। খরাসহিষ্ণু ধান সেটাও উদ্ভাবনের পথে। এখন জলমগ্ন ধান যাতে উৎপাদন করা যায় সে গবেষণা চলছে।
‘এখন তো অনেক বিদেশি তরিতরকারি, ফল আমাদের দেশে উৎপাদন হচ্ছে। এসবই কিন্তু বিজ্ঞানের অবদান, গবেষণার অবদান। এখন স্ট্রবেরি ঘরে বসে খাওয়া যায়। আগে বিদেশ থেকে আনতে গেলে নষ্ট হয়ে যেত। আর এখন আমাদের দেশেই উৎপাদন হয়। এটা মাত্র একটা দৃষ্টান্ত দিলাম।’
তিনি বলেন, ‘এ ছাড়াও এখন তো আমাদের দেশে সবকিছুই হচ্ছে। কমলালেবুর প্রসার ঘটেছে। মাল্টা থেকে শুরু করে সবকিছুই হচ্ছে, যেটা জাতির পিতা বলে গিয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যখন জাতির পিতা দায়িত্ব নেন একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, এ রকম একটা বিধ্বস্ত দেশ, কোনো সম্পদ নেই, কীভাবে গড়ে তুলবেন।
‘জাতির পিতা বলেছিলেন, আমার মানুষ আছে, মাটি আছে। সেই মানুষকেই তিনি দক্ষ করে গড়তে চেয়েছিলেন। আমরা মনে করি এটা আমাদের দায়িত্ব। আমরা এই মাটি ও মানুষ নিয়েই আজকের বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি। আমরা ভবিষ্যতে উন্নত দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করব।’
গবেষকদের মানবকল্যাণে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা এটুকু মনে রাখবেন যে, এই যে ফেলোশিপ দিচ্ছি বা অর্থ বরাদ্দ করেছি এটা কিন্তু জনগণেরই অর্থ। কাজেই জনগণের কল্যাণেই যেন লাগে সে দিকটাকে দৃষ্টি দিয়ে আপনাদের গবেষণাকাজ চালিয়ে যাবেন এটা আমরা চাই।’
রপ্তানিতে বহুমুখীকরণ
গবেষণার মধ্য দিয়ে রপ্তানিতে বহুমুখীকরণের তাগিদ দেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘গবেষণার মধ্য দিয়ে আমরা ব্যয় কমাতে পারি, উৎপাদনের উৎকর্ষতা বাড়াতে পারি, পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারি।
‘আমাদের রপ্তানি খাতে আমরা শুধু একটা বা দুটোর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করতে পারি। তার মধ্যে আমাদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলি। যেহেতু আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ, কাজেই এ ক্ষেত্রে যা যা প্রয়োজন আমরা কিন্তু তা করতে সক্ষম। আমরা তা পারি। আমাদের দেশের অনেক সুযোগ রয়েছে। রপ্তানি পণ্য বাড়াতে হলে সেখানেও কিন্তু গবেষণার প্রয়োজন আছে।’
‘অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না’
দেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে তা কেউ থামাতে পারবে না বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে এই অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না। আর করোনাভাইরাস যখন পারে নাই তখন আর কেউ পারবে না, এটাই আমার বিশ্বাস।
‘আমরা বিশ্বে একটা মর্যাদা পেয়েছি উন্নয়নশীল দেশের। বাংলাদেশকে আর কেউ অবহেলার চোখে দেখতে পারবে না। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত আমাদের এ স্বাধীনতা, এ স্বাধীনতা ব্যর্থ হতে পারে না। এই স্বাধীনতার সুফল বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে আমরা পৌঁছে দেব।’
পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখন কোনো দেশে গণতন্ত্র থাকে না, মিলিটারি ডিক্টেটর ক্ষমতা দখল করে কোনো দেশে, যেহেতু তারা ক্ষমতা দখলকারী তারা দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে না।
‘তারা ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করার জন্য যুবসমাজ, ছাত্রসমাজ সবার ওপরে যেমন অত্যাচার করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। কাজেই আমরা দেখেছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি, বোমার আওয়াজ, সেশনজট; মেধাবী ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া, অর্থ তুলে দেয়া, তাদের বিপথে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের ব্যবহার করা।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারে আসার পর এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষার একটা পরিবেশ তৈরি করি। যদিও করোনাভাইরাস আমাদের জন্য আরেকটি সমস্যা সৃষ্টি করে দিয়েছে। এক বছরের মতো আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখতে হয়েছে।
‘তবে ইতিমধ্যে আমরা ভ্যাকসিন শুরু করেছি। টিকা দেয়া কর্মসূচিতে শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। কাজেই এটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে এই মার্চ মাসেই সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে সক্ষম হব। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বেশ কিছু হল মেরামত করা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা শুরু হয়েছে।’