দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার স্থানীয় সংসদ সদস্যের অ্যাম্বাসেডর ইফতেখার আহমেদ বাবু করোনাকালে নানা প্রতারণা করে কোটিপতি হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সাংসদের কাছের লোক বলে ভয়ে এত দিন তার বিরুদ্ধে কথা বলতেন না কেউ। কিন্তু গ্রেপ্তারের পর অভিযোগের পাহাড় জমছে। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৯টি। আরও পাঁচটি অভিযোগের তদন্ত চলছে। প্রমাণ পেলে মামলা নেবে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, ইফতেখার আহমেদ বাবু একজন প্রতারক, চাঁদাবাজ, অর্থ আত্মসাৎকারী এবং জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য।
তার বাড়ি ঘোড়াঘাট উপজেলার খোদতপুর গ্রামে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর রাতে গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ইফতেখার আহমেদ বাবুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তবে গ্রেপ্তার এড়াতে বাড়ির প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন বাবু। এরপর ফেসবুক লাইভে এসে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা কথা বলতে থাকেন। অবশ্য পার পাননি তিনি। বাড়ির অন্য গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেদিন তার বাড়ির সামনে থেকে চোরাই একটি প্রাইভেট কার জব্দ করা হয়।
জানা গেছে, সেনাবাহিনীতে ১১ বছর চাকরির সুবাদে বিদেশে মিশনে গিয়েছিলেন তিনি। পরে ২০০৮ সালে নিজ এলাকায় ফিরে আসেন বাবু। এরপর স্থানীয় সাংসদ শিবলী সাদিকের অ্যাম্বাসেডর হন। কখনও সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, সাবেক সেনাসদস্য, সমাজসেবী হিসেবেও পরিচয় দিতেন।
ঘোড়াঘাট, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর ও হাকিমপুর উপজেলার মানুষের সঙ্গে নানা কৌশলে প্রতারণা করেছেন। চারটি উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের কাজের জন্য নিতেন কমিশন।
পুলিশ জানিয়েছে, বাড়ি থেকে চোরাই প্রাইভেট কার উদ্ধারের পর ৩০ ডিসেম্বর রাতে ঘোড়াঘাট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দুলু মিয়া একটি মামলা করেন। একই রাতে থানার এসআই খুরশীদ আলম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরেকটি মামলা করেন।
চলতি বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি বিকেল সোয়া ৫টায় ঘোড়াঘাট উপজেলার চাঁদপাড়ার ফজলুল হক শের আলী প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার অভিযোগে বাবুর নামে মামলা করেন। একই দিন বিকেলে উপজেলার সিংড়ার (নয়াপাড়া) মোনারুল ইসলাম প্রতারণার মাধ্যমে প্রাইভেট কার আত্মসাৎ ও হত্যার হুমকির অভিযোগে বাবুর বিরুদ্ধে মামলা করেন।
একই দিন সন্ধ্যায় একই উপজেলার কশিগাড়ীর জাহাঙ্গীর আলম প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার অভিযোগে মামলা করেন। রাতে বারোপাইকারগড় গ্রামের আব্দুর রউফ প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি ও হত্যার হুমকির অভিযোগে মামলা করেন। একই রাতে দক্ষিণ দেবীপুর গ্রামের মাসুদ রানা বিশ্বাস ভঙ্গ করে টাকা আত্মসাৎ, চাঁদা দাবি ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে মামলা করেন।
৪ জানুয়ারি রাতে চক বামুনিয়া বিশ্বনাথপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম ব্যক্তিমালিকানাধীন গাছ চুরি, চাঁদা দাবি, ভয়ভীতি ও হুমকি দেয়ার অভিযোগে বাবুর বিরুদ্ধে মামলা করেন।
সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি রাতে বিরামপুর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান অর্থ আত্মসাৎ ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ এনে বাবুর বিরুদ্ধে মামলা করেন।
ঘোড়াঘাট প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম আকাশ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইফতেখার আহমেদ বাবু নিজেকে সাংবাদিক ও এমপির এম্বাসেডর পরিচয়ে বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অপরাধ করেছেন। তার কারণে ঘোড়াঘাটের সাংবাদিকরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিলেও তিনি কোনো সাংবাদিক নন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবু কোনো পত্রিকা বা মিডিয়ায় কাজ করেন না। তার নানা অপরাধের বিষয়ে সাধারণ মানুষ আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসছেন। এমপির কাছের লোক হওয়ায় এলাকার মানুষ তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ। তবে ভয়ে কেউ থানায় অভিযোগ করতে সাহস পাননি। সাংবাদিক ও এমপির কাছের লোক পরিচয় দিয়ে এক বছরে তিনি কোটিপতি হয়েছেন। তার প্রাইভেট কার রয়েছে চারটি।’
ঘোড়াঘাট পৌরসভার ২ নং প্যানেল মেয়র ও ১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফেরদৌসা বেগম বিলকিস জানান, ‘এলাকায় বাবু নিজেকে অনেক বড় নেতা ও এমপির কাছের লোক পরিচয় দেন। আমরা এমপির পক্ষ থেকে যে বরাদ্দ পাই, সেখানে ভাগ বসাতেন। করোনার আগে তার কোনো সম্পত্তি ছিল না। কিন্তু করোনার মধ্যে কোটিপতি হয়ে গেছেন। আমার ও অন্য কাউন্সিলরদের অনেক ক্ষতি করেছেন। শুধু ঘোড়াঘাটই নয়, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর ও হাকিমপুরের জনপ্রতিনিধিদের অত্যাচার করতেন। তাদের কাজের ওপর ভাগ বসাতেন এই বাবু।’
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর রাতে গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ইফতেখার আহমেদ বাবুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত
দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক বলেন, ‘গত নির্বাচনের সময় থেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, প্রচারণায় সেভাবে ছিল। সাংবাদিক হিসেবে ফেসবুকে লেখালেখি করত। পরে আমার এমপি ডট কমে অ্যাম্বাসেডর (দূত) নিয়োগ করা হয়। পরে আমার কাছে অভিযোগ এলে আমি ব্যবস্থা নিয়েছি। বাবু অবশ্যই অনেক বড় খারাপ কাজ করেছে এবং এগুলো ক্ষমা করার বিষয় নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার এমপি ডটকমে সে কাজ করেছে, কিন্তু সে ব্যক্তিগত জীবনে কি করেছে না করেছে, তা জানি না। অভিযোগ না দিলে তো আমার জানার সুযোগ নেই। ভিতরে ভিতরে বাবু যে এতগুলো ঘটনার সাথে জড়িত ছিল, সেটি তো আমি বুঝতে পারিনি।’
সাংসদ আরও বলেন, ‘সরকারের পক্ষের কথা বলে কেউ ছাড় পাবে না। সে গ্রেপ্তার আছে। মামলা হয়েছে। শাস্তির আওতায় এসেছে। অবশ্যই সরকারের মনিটরিং আছে। প্রশাসন সেগুলো খেয়াল করছে এবং সেভাবেই পদক্ষেপ নিয়েছে।’
ঘোড়াঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিম উদ্দীন বলেন, ইফতেখার আহমেদ বাবু একজন প্রতারক, চাঁদাবাজ, অর্থ আত্মসাৎকারী। মানুষের কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে, বালু নিয়ে এবং অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারণা করেছেন। পাওনাদাররা তাকে টাকা দেয়ার জন্য চাপ দিলে পত্রিকায় তাদের নামে রিপোর্ট প্রকাশ, হত্যাসহ হুমকি দিতেন।’
এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বাবু জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের অন্যতম সদস্য। তার কাছ থেকে চারটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। সেগুলোতে প্রশ্নফাঁসের নানা ধরনের আলামত আমরা পেয়েছি।’ বাবুর বিরুদ্ধে আরও পাঁচটি লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেগুলোর তদন্ত করা হচ্ছে। প্রমাণ পাওয়া গেছে মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হবে।