বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভিক্ষুকমুক্ত এলাকার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষুক

  •    
  • ২ মার্চ, ২০২১ ০৯:১০

সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আপনারা ঢাকায় এখন যে ভিক্ষুক দেখেন তারা প্রফেশনাল ভিক্ষুক। করোনার সময়ে অনেকে বাড়ি থেকে এসে ভিক্ষা করছে। তারপরও আমরা তাদের খাবার দিয়েছি। বস্তিতেও খাবার দেয়া হয়েছে সে সময়।’

রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়া হিসেবে পরিচিত গুলশাল-বনানী সাত বছর আগে ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। অভিজাত এই এলাকায় ঢাকার অন্যান্য এলাকার মতোই ভিক্ষুকদের অবাধ বিচরণ এখন।

সবচেয়ে বেশি ভিক্ষুক চোখে পড়ে গুলশান-১ মোড় থেকে গুলশান-২ মোড় সড়কে। সিগন্যালে গাড়ি থামলেই তারা হাজির হন টাকার জন্য। এতে অনেকে বিরক্ত হন; অনেকে তাদের টাকা দিয়ে চলে যান।

২০১৩ সালে মন্ত্রিপরিষদের অনুমতি নিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় রাজধানীর ভিভিআইপি এলাকা বিমানবন্দর, সোনারগাঁও হোটেল, হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল, হোটেল র‍্যাডিসন, বেইলি রোড, মিন্টো রোড এবং কূটনৈতিক এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ অনুসারে ঘোষণাও দেয়া হয়।

পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নেতৃত্বে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়।

পুলিশ বলছে, এই কমিটির কার্যক্রমের অংশ হিসেবে রাজধানীর নির্দিষ্ট এসব এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত করতে নিয়মিত বিশেষ অভিযান চালানো হয়।

তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়মিত এসব অভিযান চালানো হয় না। মাঝেমধ্যে অভিযান চলে। ভিক্ষুকদের ‘দৌড়ানি’ দেয়া হয়। এতেও কাজ না হলে আটক করে আদালতে পাঠানো হয়। কিন্তু তারা জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও রাজপথে নামেন।

ঢাকার নবাবগঞ্জের রিপন শেখ ভিক্ষা করেন গুলশান-২-এর মোড়ে। তিনি দৃষ্টিহীন। থাকেন কড়াইল বস্তিতে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে।

রাজধানীর গুলশান-১ মোড়ে সিগন্যালে গাড়ি থামলেই হাত পাতেন ভিক্ষুক। ছবি: নিউজবাংলা

ভিক্ষুকমুক্ত এলাকায় ভিক্ষা করার কারণ জানতে চাইলে রিপন শেখ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ চইলা যাইতে কইলে চইলা যাই। মাঝে মাঝে অভিযান চললে ধইরা নিয়া যায়। গুলশান এলাকায় আমি ৩৫ বচ্ছর ধইরা আছি।

‘সরকার তো সবকিছুই মুক্ত কইরা দেয়। পলিথিনমুক্ত, মাদকমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, ভ্যাজালমুক্ত। তয় কোনডা মুক্ত হইছে আমারে কন দেহি? মুক্ত হইতে গিয়া আরও যুক্ত হইয়া যায়।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘সবাই খালি কইতে পারে। কইয়া ১০-২০ ট্যাহা ধরাইয়া দিয়া চইলা যায়। এমন কিছু কইরা দেক, যা দিয়া বউ-পোলাপাইন লইয়া খাইতে পারি।

‘সরকারি ভাতা পাই তিন মাস পর পর। তিন মাস পরে ২২৫০ টাকা দেয় সরকারে। অহন আপনে কন বউ-পোলাপাইন নিয়া এই ২২৫০ ট্যাহা দিয়া তিন মাস কেমনে বাঁচুম?’

গুলশানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন খায়রুল ইসলাম।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় সিগন্যালে সিগন্যালে গাড়ি থামলেই জানালায় এসে ভিক্ষা চায়। সবাইকে দিই না। শারীরিক কন্ডিশন দেখে টাকা দিই। তবে এই এলাকায় ভিক্ষা করলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। কারণ, এই এলাকার আশেপাশে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস। তা ছাড়া ভিআইপি লোকেরা থাকেন এই এলাকায়।’

বনানী মোড়ে সাইনবোর্ডে লেখা আছে ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা। রোববার সেই সাইনবোর্ডের পাশে ভিক্ষা করতে দেখা যায় ছয়-সাতজনকে। সিগন্যালে গাড়ি থামলেই গাড়ির জানালায় গিয়ে হাত পাতছিলেন তারা।

তাদের একজন জোহরা খাতুনের কাছে জানতে চাওয়া হয় নিষিদ্ধ এলাকায় ভিক্ষা করছেন কেন?

জবাবে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘পুলিশ মাজে-মদ্দি দৌড়ানি দেয়। আমারে একলা কইতাছেন ক্যা? দেহেন না আরও কত মাইনসে ভিক্ষা করছে। আমরা তো চুরি-ডাহাতি করি না। ভিক্ষা কইরা খাই।’

বৃদ্ধ আব্বাস আলী গুলশান-১ মোড়ে ভিক্ষা করেন। তিনিও নিউজবাংলাকে পুলিশের অভিযানের কথা জানান।

বলেন, ‘পাঁচ থেইকা সাত বচ্ছর এই এলাকায় ভিক্ষা করি। মাঝে মাঝে ধইরা লইয়া যায়। পরে জেলখানা থেইকা ছাড়ে। ধইরা লইয়া গেলে আর কি করা, খাইতে তো হইবো।’

গুলশান এলাকায় এত ভিক্ষুক থাকার কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কথা বলছে পুলিশ।

গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়ে আমরা কাজ করি। কোভিডের কারণে একটু স্লো কাজ হচ্ছে। ভিক্ষুকদের রাখার সমস্যা হচ্ছে। কয়েক দিন আগেও ভিক্ষুকদের আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। এই অভিযান চলমান আছে।’

অভিজাত এই এলাকায় এত ভিক্ষুক থাকার কারণ জানতে কথা হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসানের সঙ্গে।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিযান চলে নিয়মিতই। তবে কোভিডের কারণে ভিক্ষুক একটু বেড়ে গেছে। ভাইরাসের কারণে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয় নাই।

‘ভিক্ষুক বেড়ে যাওয়ার বিষয়টা আমরা সমাজসেবা অধিদপ্তরকে অবহিত করেছি। তারা সম্ভবত আগামী মাস থেকে কার্যক্রম শুরু করবে।’

রাজধানীর গুলশান-২ মোড়ে বিদেশির কাছে হাত পাতেন এক ভিক্ষুক। ছবি: নিউজবাংলা

এই প্রকল্পে অনেকেই জড়িত জানিয়ে মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসান বলেন, ‘আমরা যে ভিক্ষুক ধরব, ধরে রাখব কোথায়? আমরা তাদের ধরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে দিই। তারা তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখে। এই আশ্রয়কেন্দ্র যখন পূর্ণ হয়ে যায় তখন ভিক্ষুকদের রাখার জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না।’

ঢাকা উত্তরের মতো দক্ষিণ সিটিরও ভিক্ষুকমুক্ত এলাকায় ভিক্ষুকদের দেখা যায়।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি নতুন আসছি তো, তাই ভিক্ষুকদের ভিআইপি এলাকায় ভিক্ষার বিষয়টা সঠিক জানি না। আমি কথা বলে দেখব। আমি জেনে আপনাকে জানাব।’

দক্ষিণ সিটিরও কোথাও কোথাও ভিক্ষুকমুক্ত এলাকার সাইনবোর্ড নাই, আবার থাকলেও লেখা উঠে গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কথা বলে সব ঠিক করব।’

চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে বিজয় সরণি মোড়ে ঢুকতেই ভিক্ষুকমুক্ত এলাকার সাইনবোর্ড আছে। তবে লেখা অনেকটা মুছে গেছে। ফার্মগেট থেকে বিজয় সরণির রাস্তার মোড়ের সাইনবোর্ডে লেখা স্পষ্টই আছে।

তারপরও বিজয় সরণিতে পাঁচ-ছয়জনকে নিয়মিতই ভিক্ষা করতে দেখা যায়।

ভিক্ষুকমুক্ত এলাকায় ভিক্ষা করছে, আপনারা কিছু বলেন না- এমন প্রশ্নে সেখানে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ মো. মাজেদুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তাদের একদিক দিয়ে তাড়িয়ে দিলে তারা আরেক দিক দিয়ে চলে আসে। তা ছাড়া আমরা গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করব, না ভিক্ষুক নিয়ন্ত্রণ করব? মাঝে মাঝে থানার পুলিশ এসে তাদের তাড়িয়ে দেয়।’

এ প্রসঙ্গে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভিক্ষুকদের নিয়ে আমাদের একটা প্রোগ্রামই ছিল। জেলায় জেলায় ফান্ড দেয়া আছে। ঢাকা থেকে সব ভিক্ষুককে তাদের বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। তাদের বাড়িতে ঘরও করে দেয়া হয়। কিন্তু তারা আবার ঢাকায় চলে আসে।

রাজধানীর গুলশান-১ মোড়ে প্রাইভেটকারের সামনে ভিক্ষুক

‘আপনারা ঢাকায় এখন যে ভিক্ষুক দেখেন তারা প্রফেশনাল ভিক্ষুক। করোনার সময়ে অনেকে বাড়ি থেকে এসে ভিক্ষা করছে। তারপরও আমরা তাদের খাবার দিয়েছি। বস্তিতেও খাবার দেয়া হয়েছে সে সময়।’

ভিক্ষুকমুক্ত করার চেষ্টা চলছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী আশরাফ বলেন, ‘তবে ভিক্ষুকমুক্ত করাটা খুব কঠিন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিক্ষুকদের প্রতিষ্ঠিত করা, তাদের এলাকায় পাঠানোর, বাড়ি করে দেয়া ও কিছু টাকা দেয়ার প্রোগ্রামই ছিল। এই প্রোগ্রাম চলমান। মুজিববর্ষের যে ঘর দেয়া হচ্ছে সেখানে ভিক্ষুকরাও পাচ্ছে।’

ভিক্ষুকদের ভাষ্যমতে, তাদের তিন মাস পর পর ২২৫০ টাকা দেয়া হয়। এই টাকায় তারা কীভাবে চলবে?

এমন প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আপনি তাদের জিজ্ঞাসা করবেন, তোমাদের আগে যে টাকা দেয়া হয়েছে, তোমাদের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে- তারপরেও তো তোমরা বাড়ি ছিলা না। ২০১৩ সালে আইন পাসের পর তাদের যেখানে যেখানে বাড়ি সেখানে ঘরও করে দেয়া হয়েছিল।’

তিনি জানান, গ্রাম ও ছোট শহরে ভিক্ষুক পাওয়া যায় না। ভিক্ষুক পাওয়া যায় ঢাকা শহরে। তাও মাঝে কম ছিল, এখন কিছুটা বাড়ছে।

তাদের নিয়ে কি নতুন কোনো প্রকল্প হবে, জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘প্রকল্প তো চলমান। আমরা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতেও তাদের পাঠিয়েছি। সেখানে দেখা যায়, কিছুদিন পরে কোনো আত্মীয় এসে তাদের নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরেই তারা আবার ঢাকা চলে আসে। এটা তাদের ব্যবসা।’

এ বিভাগের আরো খবর