আগরতলা মামলার প্রেক্ষাপটে সে সময়কার বাঙালি সশস্ত্র সেনারা দেশ স্বাধীন করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে এই প্রস্তুতিই কাজে লেগেছে। দ্রুত প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করা গেছে, যা থেকে সফলতা এসেছে।
এ কথা বললেন ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট আব্দুল জলিল (অব.)।
শনিবার বিকেলে ‘বঙ্গবন্ধুর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত ‘বিজয় কেতন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে’ এটির আয়োজন করে শিশু-কিশোর সংগঠন ‘ঘাসফুল’। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন ঘাসফুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হাসান আব্দুল্লাহ বিপ্লব।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। মামলার পূর্ণ নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয়, শেখ মুজিব ও অন্যান্যেরা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন।
এ মামলার অভিযুক্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট আব্দুল জলিল (অব.) মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলেন।
তিনি জানান, তৎকালীন পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জোয়ানদের মধ্যে স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল আগরতলা মামলার অনেক আগেই।
ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার প্রেক্ষাপট ও দেশ স্বাধীন করার প্রস্তুতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘১৯৬২ সালে করাচিতে স্টুয়ার্ড মুজিব, সুলতান উদ্দিন আহমেদ, নূর মোহাম্মদ, লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন (আগরতলা মামলার আসামি) বসে চিন্তা করেন, “এই যে আমরা এমন ট্রেনিং পেয়েছি, তা যদি পাকিস্তানিদের জন্য কাজে না লাগিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লাগাতে পারতাম।” তখন একটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন করা হয়। বাইরে ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নাম হলেও ভেতরে তা ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতা করার জন্য।’
আগরতলা মামলার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু করাচি গেলে তিনি বেগম আকতার সোলেমানের বাসায় (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে) ছিলেন। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনসহ অন্যারা সেই বাসায় একটি বিপ্লবী বৈঠক ডাকেন।’
আব্দুল জলিল বলেন, ‘এর আগে অনেক নেতার কাছে আমরা প্রস্তাব নিয়ে গেছি, তারা ভয়ে দৌড় মেরেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা যিনি বললেন, “বয়েজ, গো অ্যাহেড।” এরপর আমাদের সদস্য সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে লাগল। তখন তাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র খোলা দরকার। যে জন্য আমার বাসায় প্রশিক্ষণকেন্দ্র খোলা হয়।’
তিনি প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে হঠাৎ আক্রমণ করে অস্ত্রাগারগুলি দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করব। এ জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র খোলা হয়। আমাদের যে পরিকল্পনা ছিল, হঠাৎ আক্রমণ করে আমরা পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করে ফেলব।’
তিনি বলেন, ‘ওই যে আমরা যে গ্রাউন্ডওয়ার্ক করেছিলাম, সেই গ্রাউন্ডওয়ার্কের ফলেই বঙ্গববন্ধু যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, সাথে সাথে পাকিস্তান আর্মি, নৌ ও বিমানবাহিনীর সব বাঙালি কর্মকর্তারা মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে নেমে পড়ল। এই ওয়ার্কটা আমরা আগে করেছিলাম বলেই আমরা পরে সফলতা পেয়েছিলাম।’
দেশ স্বাধীন করার এ তৎপরতার তথ্য সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে জানিয়ে দিয়েছিল বলে জানান আব্দুল জলিল। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে দু-একজন ছিল, যারা বিট্রে করেছে। তারা আর্মির কাছে খবর পৌঁছে দিয়েছিল।’
ঐতিহাসিক ওই মামলার (বৈরী) সাক্ষী আবুল হোসেন অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আসলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ষড়যন্ত্র ছিল না। ওই মামলায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকেরা।’
সে সময়ের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমি বলেছি, “শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আমি কোনো সাক্ষী দেব না।” এরপর আমার ওপর চলে অমানবিক অত্যাচার, জুলুম। এরপর আমি নিজে নিজে একটা পরিকল্পনা করলাম। আমি এখানেই একটা সেলে থাকতাম। তখন আমি স্বীকার করি যে, শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আমি সাক্ষী দেব। তখন আমাকে ভাল খাওয়া দেওয়া শুরু করল। আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা শুরু করল। তখন আমাকে নিয়ে আসল কাঠগড়ায়। যখন আমাকে সাক্ষী দিতে বলল, আমাকে বলল, “বলো, শেখ মুজিবুর হ্যায়”, আমি তখন তাদের ঢাকাইয়া ভাষায় বললাম, “আমি শেখ সাহেবকে চিনি না। আমি উনাকে কোনো দিন দেখি নাই।”’
আবুল হোসেন বলেন, ‘এরপর আমাকে আবার সেলে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন শুরু করল, যা সহ্য করার মতো না। আমাকে আবার বলা হলো, “তুই আবার বলবি, আমি আগে যা সাক্ষী দিয়েছি, তা সব মিথ্যা।” আমি বললাম, “আমি যা বলছি, সেটাই সত্য।” এরপর আবার শুরু হলো টর্চার। সে টর্চারের কথা মনে হলে এখনও আমি শিউরে উঠি। এরপর সার্জেট জহুরুল হককে গুলি করে মেরে ফেলল। বাইরে আন্দোলন হলো। আন্দোলনের মাথায় আমরা সবাই মুক্তি পেয়ে গেলাম। আন্দোলন না হলে আমরাও মুক্তি পেতাম না। কাউকে ফাঁসি দিত, কাউকি যাবজ্জীবন দিত।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ড. গওহর রিজভী বলেন, ‘৬২ সালে বঙ্গবন্ধু ত্রিপুরায় গিয়েছিলেন। তিনি প্রথমবার ত্রিপুরায় ভারতীয় সরকারের সাহায্য নিতে যাননি, যে আমাদের অস্ত্র দাও আমি যুদ্ধ করব। উনি (বঙ্গবন্ধু) বললেন, “আমি সংবিধানিক যোদ্ধা, গণতান্ত্রিক যোদ্ধা। আমি আন্দোলন করে দেশ স্বাধীন করবো।”’
গওহর রিজভী বলেন, ‘জলিল সাহেব যে বললেন, ওনাদের সংগ্রামের কথা, এটা ভেরি ট্রু, ভেরি কারেক্ট। উনি (বঙ্গবন্ধু) সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মেয়ের বাসায় ছিলেন। ভেরি কারেক্ট। যখন কমান্ডার মোয়াজ্জেম বঙ্গবন্ধুকে এ পরিকল্পনার কথা বললেন, তখন তিনি বলেন, “তোমরা নিজেদের সংগ্রাম করো। আমি গণতান্ত্রিক। আমি রাজনৈতিকভাবে সংগ্রাম করব। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে আছি।”’
গওহর রিজভী বলেন, ‘যখন আগরতলা মামলা শুরু হলো, তখন পাকিস্তানিরা কিন্তু জানত না, বঙ্গবন্ধু ৬২ সালে ভারতে গিয়েছিলেন। তাদের কাছে কোনো তথ্য ছিল না।’
অনুষ্ঠানে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় শিশু-কিশোরদের তুলির আঁচড়ে উঠে আসে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। এছাড়া আবাহমান বাংলার প্রকৃতি তুলে ধরে শিশুরা।
এছাড়া সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ইতিহাস বর্ণনা করেন ঘাসফুলের ক্ষুদে শিল্পীরা।