জাপানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসেফিক উদ্যোগ’-এ বাংলাদেশকে চায় দেশটি। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ-জাপান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের টেলিকনফারেন্সে এই আমন্ত্রণ জানানো হয়।
বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
২০২০ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের উপপরাষ্ট্রমন্ত্রী এডওয়ার্ড বিগান বাংলাদেশ সফরে এসেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে এই জোটে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রও এই জোটের প্রাথমিক সদস্য। এছাড়া জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন এই জোটে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের জাপানি যে কাউন্টার পার্ট আছে, তিনি সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র ভাইস মিনিস্টার হিরোশি সুজুকি। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে।
‘আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এ আলোচনায় তারা তাদের ওপেন ইন্দো-প্যাসেফিক যে উদ্যোগ আছে, তাতে আমাদের অংশগ্রহণকে বিশেষভাবে চাইছে। তারা এখানে দ্রুত আমাদের সংযুক্ত করতে চায়। এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমরাও বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছি।’
২০২২ হবে নতুন সম্পর্ক রচনার বছর
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘জাপানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বাধীনতার শুরু থেকেই। তারপর ১৯৭৩ সালে জাতির পিতার জাপান সফরের মাধ্যমে এ সম্পর্ক সিমেন্টেড হয়। তারপর থেকে আমরা আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরে যান। পরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এসেছিলেন বাংলাদেশে।
‘তখন থেকে আমাদের দুই দেশের সম্পর্ককে একটি কম্প্রিহেনসিভ সম্পর্ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলাম। তাদের সঙ্গে ইকোনমিক রিলেশনশিপ এবং তার বাইরে ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ডিপ্লোমেটিক সম্পর্ক তো আছেই। তবে আমরা আলোচনা করেছি এই কম্প্রিহেনসিভ রিলেশনটাকে কীভাবে একটি স্ট্রাটেজিক সম্পর্কে রূপান্তর করা যায়, তা নিয়ে। এর এলিমেন্টগুলো কী কী হবে এবং এর বিল্ডিং ব্লকসগুলো কী কী হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছে।’
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমরা এ বছর কোভিড সিচুয়েশনের জন্য যথাযথ প্ল্যান করতে পারছি না। তারাও অত্যন্ত সাবধানি জাতি। আগামী বছর ২০২২ সালে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি হবে, তারা ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল।
‘সেই উপলক্ষে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সব মিলিয়ে দুদেশের মধ্যে অনেক অনেক প্রোগ্রাম নেয়া হবে। তার মধ্যে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যেন দুই দেশ ভ্রমণ করতে পারেন- সে বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি ওনাদের যে সম্রাট তার জন্মদিন উপলক্ষে সে দেশ ভ্রমণে যাবেন। আমাদের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সে দেশের সম্রাট নারুহিতো ও সম্রাজ্ঞীকে আমাদের দেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু করোনার কারণে তারা আসতে পারেননি।
‘আমরা আশা করব, ২০২২ সালে আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচিত হবে।’
‘বিগ বি’ নিয়ে বড় প্ল্যান জাপানের
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আগামী বছরে গিয়ে বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কের মধ্যে স্ট্রাটেজিক রিলেশনশিপ যেমন স্টাবলিস্ট হবে, তেমনি আমাদের ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ও অন্যান্য সম্পর্ক যা আছে তা নতুন মাত্রা পাবে।’
মাতারবাড়ী ও দক্ষিণ চট্টগ্রামকে ঘিরে বিগ বি প্ল্যান। ছবি: জাইকা
তিনি বলেন, ‘ওদের যে বিগ বি প্ল্যান আছে, বিশেষ করে মাতারবাড়ী ও সাউদার্ন চিটাগাংকে কেন্দ্র করে, সেটা এই পুরো অঞ্চলিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কীভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সেটা মাথায় নিয়ে এগোচ্ছে জাপান।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষ করে সাউদার্ন চিটাগাং বিষয়ে তাদের খুব বেশি আগ্রহ রয়েছে, সেটার মাধ্যমে নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া আছে, মিয়ানমার আছে। সব মিলিয়ে এটা তাদের বড় প্ল্যানের অংশ। আমরাও তাদের সেই প্ল্যানে শরিক হতে চাই বা অলরেডি হয়েছি।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সমর্থন
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘রোহিঙ্গা বিষয়ে আমরা কথা বলেছি। বিশেষ করে মিয়ানমারের ক্যুর পরে আমাদের কীভাবে পজিশনিং করতে হচ্ছে, সেটা আমরা শেয়ার করেছি। আমরা তাদের এক্সপ্লেইন করেছি, তারা আমাদের বিষয়টি বুঝেছে। আমাদের মূল টার্গেট হলো প্রত্যাবাসন। তারা বিষয়টিকে রেসপেক্ট করে। আমরা এ বিষয়ে তাদের সহায়তা চেয়েছি।
‘আমরা ভারতকেও এই কথা বলেছি। আমরা বলেছি, প্রত্যাবাসনের পর যখন রোহিঙ্গারা আমাদের বর্ডার ক্রস করবে, তখন তাদের সেফটি, সিকিউরিটি অ্যান্ড সাসটেইনেবল লাইভলিহুড বিষয়ে আমাদের আশপাশের প্রতিবেশীদের বড় ধরনের ভূমিকায় দেখতে চাই।’
বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের প্রথম বৈঠক হয় ২০১৬ সালে ঢাকায়। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় বৈঠক হয় টোকিওতে। এবার তৃতীয় বৈঠক হলো।
জাতিসংঘে সমর্থন পাবে জাপান
বৈঠক সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ প্রাপ্তিতে জাপানকে সমর্থন করবে বাংলাদেশ। এছাড়া বাংলাদেশ ও জাপান উভয়ই জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একে অপরকে সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ডিসকোর্সে বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রশংসা করে জাপানি উপমন্ত্রী সুজুকি বাংলাদেশের উন্নয়নে অব্যাহত সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি জাপানের ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিকের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বলেন, এটা শান্তি ও বিকাশের একটি ধারণা।
বিমানকে স্বাগত জানাবে টোকিও
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকা থেকে টোকিওতে সরাসরি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট চালানোর পরিকল্পনার কথা জানান সুজুকিকে। এই পথে পুনরায় ফ্লাইট চালানোর পরিকল্পনারও প্রশংসা করেন জাপানি উপমন্ত্রী। তিনি বলেন, এর ফলে এই এয়ার-লিঙ্ক আরও বেশি লোককে যোগাযোগ করতে এবং ব্যবসা প্রসারে সহায়তা করবে।