২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে পিলখানার আশপাশের আবাসিক এলাকাগুলোয় যাদের ঘুম ভেঙেছিল দূরবর্তী আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জনে, তাদের পক্ষে অনুমান করাও কঠিন ছিল দেয়ালঘেরা বিডিআর সদর দপ্তরের ভেতরে তখন কী ভয়াবহ এক বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে চলেছে।
বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংসতার দিকটি পুরোপুরি উন্মোচিত হতে আর দুটো দিন লেগে গেছে।
আগের দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে তিন দিনব্যাপী রাইফেলস সপ্তাহের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাত্রই ৪৯ দিন আগে ক্ষমতা নিয়েছেন তিনি।
উৎসবের মধ্য দিয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল রাইফেলস সপ্তাহের তিন দিনের বর্ণিল আয়োজন। কিন্তু তার আগেই ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ভারী অস্ত্র, বুলেটের গর্জন আর বিডিয়ার জওয়ানদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সেই আয়োজনকে করে দেয় মলিন। দেশজুড়ে তৈরি হয় শোকের আবহ।
২৫ ফেব্রুয়ারি যা ঘটেছিল
২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় পিলখানায় দরবার হলে শুরু হয় বার্ষিক দরবার। সারা দেশ থেকে আসা বিডিআর জওয়ান, জেসিও, এনসিওসহ ২ হাজার ৫৬০ জন সদস্যে তখন পরিপূর্ণ দরবার হল। দরবার মঞ্চে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান, মামলার অভিযোগপত্র ও সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, জওয়ানদের একটি দল সকাল ৯টার কিছু আগে অস্ত্রাগারে গিয়ে সেখানে দায়িত্বরত এক মেজরকে জিম্মি করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। সেখানে দায়িত্বরত কোনো বিডিআর সদস্য তাতে বাধা দেননি।
দরবারে বিডিআর মহাপরিচালকের বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে সিপাহি মইন ও সিপাহি কাজল অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন। মইন ছিলেন সশস্ত্র। কাজল পেছনে থাকেন আর মইন অস্ত্র হাতে মঞ্চে উঠে মহাপরিচালক শাকিল আহমেদের দিকে অস্ত্র তাক করেন।
এ সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএ বারি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে জুতার ফিতা দিয়ে বেঁধে নিরস্ত্র করেন। সঙ্গে সঙ্গে বিপথগামী বিডিআর জওয়ানদের একটি অংশ দরবার হলে ঢুকে মহাপরিচালকের সামনে তাদের নানা দাবি নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন। মহাপরিচালক শাকিল সবাইকে বারবার শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান এবং প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিজ নিজ ইউনিট সামাল দিতে বলেন। তখনই সিপাহিদের মধ্য থেকে ‘জাগো’ স্লোগান আসে।
এরপরই সিপাহি সেলিম রেজার নেতৃত্বে একটি দল সশস্ত্র অবস্থায় দরবার হলে ঢুকে পড়লে সব পরিস্থিতি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
দরবার হলের বাইরে শোনা যায় গুলির আওয়াজ। কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন বিদ্রোহীরা। দরবার হলের বাইরে পা রাখামাত্র মহাপরিচালককে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন চার সেনা। এরপরই হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে।
তারও আগে দরবার হলের বাইরে প্রথমেই হত্যা করা হয় তখনকার ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিবুল হককে।
শুরু হয় পিলখানাজুড়ে তাণ্ডব। চলে সেনা কর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারকে হত্যা, নির্যাতন, জিম্মি, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা।
খবর পেয়ে সাভার ও ঢাকা সেনানিবাস থেকে সাঁজোয়া যান এবং ভারী অস্ত্র নিয়ে পিলখানার দিকে রওনা হন সেনাসদস্যরা। বেলা ১১টার মধ্যেই তারা ধানমন্ডি ও নীলক্ষেত মোড়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেন। বিডিআরের ১ ও ৫ নম্বর গেটের আশপাশসহ বিভিন্ন পয়েন্টে আর্টিলারি গান ও সাঁজোয়া যান স্থাপন করা হয়। বিদ্রোহীরা সদর গেট ও ৩ নম্বর গেট থেকে সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন।
দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন বিদ্রোহীরা। তারা মাইকে জানান, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পিলখানায় আসতে হবে।
দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদাপতাকা নিয়ে পিলখানার ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিডিআর প্রতিনিধিদলের দেখা করার ব্যবস্থা করেন।
মূলত পিলখানায় কর্মরত ডিএডি তৌহিদ, ডিএডি নাসির উদ্দিন খান, ডিএডি মির্জা হাবিবুর রহমান, ডিএডি আবদুর রহিম, ডিএডি জলিল, সিপাহি সেলিম রেজাসহ কয়েকজন এসব ঘটনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।
ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে নানক সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন বিদ্রোহী জওয়ানরা। তারা আগের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেন। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি যা ঘটেছে
২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে পিলখানায় বিডিআরের সংখ্যা কমতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে পোশাক পালটে পিলখানার বিভিন্ন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকেন বিডিআর জওয়ানরা।
একপর্যায়ে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা আবার অস্ত্র সমর্পণের কথা বলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে তারা অস্ত্র এবং অস্ত্রাগারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার চাবি বুঝিয়ে দেন।
পরে পুলিশ পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের।
উন্মোচন হয় হত্যাযজ্ঞ
২৭ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ভেতরে সন্ধান মেলে একাধিক গণকবরের। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। সে বিদ্রোহে প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। পিলখানা থেকে উদ্ধার হয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রেনেডসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র।
ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, দরবার অনুষ্ঠানের আয়োজনকে সামনে রেখেই ষড়যন্ত্রকারীরা নিয়েছিল বিদ্রোহের প্রস্তুতি। সে ষড়যন্ত্র গোয়েন্দারাও আঁচ করতে পারেনি।
বিদ্রোহের বেশ কয়েক দিন আগে বিডিআর সদস্যরা জাতিসংঘ মিশনে যাওয়ার সুযোগ না থাকা, রেশন-বৈষম্য, ডাল-ভাত কর্মসূচির নামে টাকা আত্মসাতের অভিযোগসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপসসহ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করা ও কথা বলার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের কাছে দাবিগুলো তুলে ধরেন তারা।
বিডিআরের কিছু সদস্য কয়েকটি দাবি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আসছিলেন। পাশাপাশি অন্যদেরও দলে ভেড়ানোর চেষ্টা ছিল তাদের।
২৪ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সপ্তাহ শুরুর দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় আসেন। ইতিমধ্যে প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের দাবিদাওয়ার কিছু না হওয়ায় সুবেদার গোফরান মল্লিকের নেতৃত্বে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন কয়েকজন জওয়ান।
এর আগেই তারা দাবিদাওয়া নিয়ে বিডিআর ৫ নম্বর ফটকের কাছে এক কোচিং সেন্টারে প্রচারপত্র বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় তা বিতরণ করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর সঙ্গে তার বাসার কাছে কয়েকজন বিডিআর সদস্য কথা বলেন এবং পিন্টু তাদের ৫ নম্বর ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দেন।
২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টায় দরবার শুরু হওয়ার আগে সিপাহি মইন উদ্দিন ও সেলিম রেজার নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা জড়ো হন। শুরু হয় বিদ্রোহ।