শতাধিক ঘরের বসতি রাজধানীর মানিকনগরের কুমিল্লা পট্টি। রোববার বিকেলে লাগা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব। বসতির এক কিনারায় স্বামী, সন্তান ও দেবর নিয়ে থাকতেন ফাতেমা।
অন্যের বাসায় কাজ করেন তিনি। স্বামী দিনমজুর, আর দেবর বয়সে ছোট এবং মেয়ের বয়স চার। গত কয়েক বছরে জমিয়েছিলেন প্রায় ৯০ হাজার টাকা। যা সুরক্ষিত ছিলো ঘরের ভেতর একটি ট্রাঙ্কে।
কিন্তু আগুন থেকে রক্ষা করতে পারেনি সেই ট্রাঙ্কের টাকা। পুড়ে গেছে সব টাকা। নগদ টাকার পাশাপাশি ঘরে থাকা ফ্রিজ, ফ্যান, খাট, কাপড়-চোপরসহ সবই পুড়ে গেছে তার। পড়নে থাকা কাপড়গুলোই রয়ে গেছে শুধু সম্বল হিসেবে।
সব হারিয়ে দিশেহারা এই পরিবার। রোববার বিকেল ৩টা ২০মিনিটে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে পৌনে ৫টার দিকে।
মানিকনগর কবরস্থান ঘেঁষা বসতিটি কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার বানানো। দশ বছরের বেশি সময় ধরে এই বসতিতে ভাড়ায় থাকতেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। ২-৩ হাজার টাকায় প্রতিটি কক্ষে ভাড়ায় থাকতেন এই মানুষগুলো। তিলে তিলে করেছিলেন আসবাবপত্র, জমিয়েছিলেন টাকা। আসবাব, টাকা সবই হারিয়েছে এই শ্রমজীবী মানুষরা।
রোববার সন্ধ্যায় কুমিল্লা পট্টিতে গিয়ে দেখা গেছে, আগুন লাগার কারণে বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বসতিসহ আশপাশের কিছু ঘরবাড়িতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে মোবাইলের আলো জ্বেলে ধ্বংসস্তুপে কিছু অক্ষত রয়েছে কিনা খুঁজছেন বস্তিবাসীরা। এক প্রান্তে স্বামী, সন্তান ও দেবরসহ বসে কাঁদছিলেন ফাতেমা।
সাংবাদিক পরিচয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরই দেখাতে লাগলেন ট্রাঙ্কের ভেতরে পুড়ে যাওয়া সব টাকার নোটের অংশবিশেষ। বলছিলেন, ‘সব শেষ। যা জমাইছিলাম সব শেষ। নিজের জীবনটা নিয়া বাইর হইছি। কিচ্ছু নিতে পারি নাই।’
‘আমি ঘুমাইতেছিলাম। ছোডু মাইয়াডা বাইরে ছিল। ঘুমের মধ্যে শুনলাম আগুন। দৌঁড়ে বাইর হইছি। আগে মাইয়াডারে খুঁইজা নিছি। এতক্ষণ ঘরে কী আছে, কী নাই মনে আছিল না। যতক্ষণে মনে হইছে, চাইয়া দেহি জ্বলতাছে সব।’ বলছিলেন ফাতেমা।
ফাতেমার মতো সব হারিয়ে নিঃস্ব পোশাক শ্রমিক মেহেরুন্নেছা শিউলি। আগুন লাগার খবর শুনে বসতিতে ছুটে এসেছেন। এসে দেখেন তার সাজানো ঘরসহ পুরো বসতি জ্বলতেছে। এই শহরে মাথা গুজার ঠাঁইটুকুও আর রইল না। মাকে নিয়ে তিনিও ধ্বংসস্তুপের ধুমড়ে মুচড়ে থাকা টিনগুলো সরিয়ে কিছু রক্ষা পেয়েছে কিনা খুঁজছেন।
তিনি জানান, ‘এক বাড়িওয়ালার ঘর থেকে প্রথমে ধোঁয়া উড়ছিল। এই ধোঁয়া দেখে কেউ পাত্তা দেয়নি। কিন্তু হঠাৎ বাতাসে দাউদাউ করে আগুন ধরে যায়। এবং মহুর্তেই সব বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে।'
আগুন পুরো বসতিতে ছড়িয়ে পড়লেও গুরুতর আহত কেউ হননি বলে জানিয়েছেন মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রলয় কুমার সাহা। তিনি বলেন, ‘হুড়োহুড়ি করে বের হতে গিয়ে কয়েকজন সামান্য আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হওয়ার কোনো তথ্য আমরা পাইনি।'
প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ জানা না গেলেও, বসতির ঘরগুলো কাঠ, বাঁশ ও টিন দিয়ে তৈরি হওয়ায় দ্রুত আগুন ছড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বসতির প্রায় সব ঘর পুড়ে গেছে। পাশে অনেকগুলো বহুতল ভবন ছিল। সেখানেও আগুন ছড়িয়ে পড়ত। তবে আমাদের অনেকগুলো ইউনিট কাজ করার সেটা আর ছড়ায় নি।
বসতিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছাতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। দেবাশীষ বর্ধন বলেন, রাস্তা সরু হওয়ায় আমাদের গাড়ি ভিতরে নিয়ে আসা যাচ্ছিল না। অনেক ঘুরে আসতে হয়েছে। পানির উৎস হিসেবে সিটি কর্পোরেশনের খালের ময়লা পানি ব্যবহার করতে হয়েছে।'
কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরুপন ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানার জন্য সোমবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।