নোয়াখালীর বসুরহাটে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কিরের মৃত্যু কাদের গুলিতে হয়েছে তা অনুসন্ধানে নেমেছে পুলিশ। উঠেছে সুষ্ঠু বিচারের দাবি।
শুক্রবার বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার সমর্থক ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন মুজাক্কির। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে শনিবার রাতে সেখানে তার মৃত্যু হয়।
গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির
২৫ বছর বয়সী মুজাক্কির দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার কোম্পানীগঞ্জের প্রতিনিধি ছিলেন। তরুণ এই সাংবাদিকের মৃত্যুতে রোববার বিকেল পর্যন্ত কোনো মামলা না হলেও বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নেমে পড়েছে পুলিশ।
রোববার বিকেলে নিউজবাংলাকে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি মীর জাহেদুল হক বলেন, ‘সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনও (রোববার দুপুর পর্যন্ত) থানায় মামলা হয়নি।
‘পরিবারের অভিযোগের আলোকে এ বিষয়ে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ ছাড়া কাদের গুলিতে বুরহান গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, সেটি বের করতে পুলিশ ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে।’
মুজাক্কিরের মৃত্যুতে পুরো নোয়াখালীর পরিস্থিতি এখন উত্তাল। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন স্থানীয় লোকজন ও সেখানকার সাংবাদিক সমাজ।
ঘটনাস্থলের দোকানগুলোতে লাগানো সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের দাবি জানিয়েছেন তারা। মুজাক্কির কাদের ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তা সিসিটিভির ফুটেজের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে বলে ধারণা তাদের।
থামছে না মায়ের রোদন
রোববার দুপুরের দিকে জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর ফকিরা গ্রামে নিহত সাংবাদিক মুজাক্কিরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে পুত্রহারা মা মমতাজ বেগমে শোকের মাতম।
আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধুমহল সবাই আছেন, নেই শুধু মুজাক্কির। বারবার ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছেন মা মমতাজ বেগম। বোন ফেরদাউস, নুর নাহার, গুল জাহান, গুল নাহার ও স্বজনদের কান্নায় সেখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।
মুজাক্কিরকে যারা হত্যা করেছে, তাদেরকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়ে মা মমতাজ বলেন, ‘আমার ছেলে হিয়ানে গেছে আর গুলি খাইছে, গুলি। অ্যাঁই আছিলাম অ্যাঁর বাপের বাড়িত। অ্যাঁই কিছু তো কঁইতাম হাইতাম ন। তারা অ্যাঁর ছেলেরে গুলি করে মারি হালাইছে।
‘অ্যাঁর বাবা আর ফিরে আইসতো ন। অ্যাঁর ছেলেরে শেষ করে দিছে। অ্যাঁর ছোট ছেলে মুজ্জাকির, তার হত্যার বিচার চাই।’
নিহত সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কিরের বাড়িতে স্বজনদের ভিড়। ছবি: নিউজবাংলা
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
মুজাক্কির যখন গুলিবিদ্ধ হন তখন পাশেই ছিলেন স্থানীয় মোজ্জামেল হক। নিউজবাংলাকে তিনি জানান, শুক্রবার সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে কাদের মির্জার সমর্থকদের সঙ্গে উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
মোজ্জামেল বলেন, ‘ওই সময় ছবি তুলছিল সাংবাদিক মুজাক্কির। এ সময় হঠাৎ করে আমাকে বাঁচান বলে মাটিতে পড়ে যায় মুজাক্কির। পরে আমিসহ আরও লোকজন এসে তাকে হাসপাতাল পাঠাই।’
বড় ভালো লোক ছিল
এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছে মুজাক্কিরের বন্ধু মহল। নিহত সাংবাদিকের বন্ধু রিয়াজ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বন্ধু মহলের মধ্যে সবছে ভালো এবং মেধাবী ছিল মুজ্জাকির। সে কখনও কারও সঙ্গে বেয়াদবি করেনি। সব সময় বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল।’
অপরাজনীতির বলি
ভগ্নিপতি আবদুস ছাত্তার ও শেখ মশিউর রহমানের ভাষায়, তাদের শ্যালক অপরাজনীতির শিকার।
আবদুস ছাত্তার বলেন, ‘আমরা কোন রাজনীতি বুঝিনা। আমরা বুঝি আজকে অপরাজনীতির বলি হয়েছেন দেশের একজন বিবেকবান সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজ্জাকির। আমরা আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে মুজাক্কিরের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করছি।’
এখনও মামলা করেননি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, মুজাক্কিরের লাশ ঢাকা থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে আনা হচ্ছে। রাত ৮টায় জানাযার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হবে। দাফন সম্পন্ন হলেই মামলা করা হবে।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাটে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির। ছবি: নিউজবাংলা
চলছে প্রতিবাদ
দুপুরে নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সামনের সাংবাদিক মুজাক্কিরকে হত্যার প্রতিবাদে এবং হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে নোয়াখালী প্রেসক্লাবের ব্যানারে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে।
প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা জানান, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জার তথাকথিত ‘সত্যবচনে’ অশান্ত হয়ে ওঠা কোম্পানীগঞ্জে বিবাদমান দুই পক্ষের অপরাজনীতির নির্মম বলি হয়েছেন মুজাক্কির।
বক্তাদের আহ্বান, ওই ঘটনায় যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।
একই সময়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় জেলার চাটখিল ও কোম্পানীগঞ্জেও।
সাংবাদিক মুজ্জাকির হত্যায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ.এইচ.এম খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম। এতে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নেয়া হচ্ছে মুজাক্কিরের মরদেহ। ছবি: নিউজবাংলা
পেছনের গল্প
ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ নোয়াখালীর স্থানীয় নেতাদের নিয়ে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার আপত্তিকর নানা মন্তব্য নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে উত্তাল নোয়াখালীর রাজনীতি অঙ্গন।
কাদের মির্জার বিরুদ্ধে গত শুক্রবার বিকেলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চাপরাশিরহাট বাজারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল।
মিছিলটি বিকেল পাঁচটায় বাজারসংলগ্ন তার বাড়ি থেকে বের হয়ে চাপরাশিরহাট মধ্যম বাজারে গেলে কাদের মির্জার অনুসারীরা মিছিলে হামলা চালান। এ সময় সেখানে উপস্থিত পুলিশ দুই পক্ষকে দুই দিকে ধাওয়া করে এবং ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর কাদের মির্জার নেতৃত্বে তার শতাধিক অনুসারী মোটরসাইকেল ও গাড়িযোগে চাপরাশিরহাট এলাকায় যান। এক পর্যায়ে গোলাগুলি শুরু হয়।
এ সময় গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির। গুলিতে তার মুখের নিচের অংশ এবং গলা ঝাঁজরা হয়ে যায়। মুজাক্কির ছাড়াও গুলিবিদ্ধ অন্তত পাঁচ জন।
ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন আহতদের প্রথমে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখান থেকে সন্ধ্যায় নেওয়া হয় নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে।
রাতেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় মুজাক্কিরকে। সেখানে অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। শনিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার ছাড়াও বার্তা বাজার ডটকমের নোয়াখালী প্রতিনিধি ছিলেন।