ভাষার জন্য যারা ঢাকার রাজপথে জীবন দিয়েছিলেন ৬৯ বছর আগে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে গোটা জাতি। অমর একুশের প্রথম প্রহরে শনিবার মধ্যরাত থেকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ভরে উঠবে ফুলে।
এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের বেদি প্রস্তুত করা হয়েছে। শহিদ মিনারের আশপাশের রাস্তায় আঁকা হয়েছে আল্পনা। সুদৃশ্য দেয়াললিখনে ভরে উঠেছে আশপাশের দেয়াল।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলতে সবরকম প্রস্তুতি নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশাসন নিয়েছে প্রস্তুতি।
শহিদ মিনারের সব প্রবেশমুখে হাত ধোয়ার জন্য বেসিন ও লিকুইড সাবান রাখা হবে। মাস্ক ছাড়া কাউকে শহিদ মিনার চত্বরে ঢুকতে দেয়া হবে না।
১৯৯৯ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই এখন সারা বিশ্বের মাতৃভাষাগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে।
রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে একুশের কর্মসূচি।
তবে করোনার কারণে এবার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্বশরীরে শহীদ বেদিতে থাকবেন না। তাদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাবেন তাদের সামরিক সচিবেরা।
কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরিসহ আজিমপুর কবরস্থানে শহিদদের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা জানানো হবে।
রোববার রাজধানীর সেগুন বাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে প্রথমবারের মতো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক’ দেয়া হবে। গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে বিজয়ীদের পদক দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
আল্পনায় রাঙিয়ে উঠেছে প্রাণের মিনার
শনিবার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার পরিদর্শন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো আখতারুজ্জামান। সার্বিক প্রস্তুতি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন উপাচার্য। বলেন, রাষ্ট্রাচার অনুযায়ী একুশের প্রথম প্রহরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের বেদিমূল প্রস্তুত করা হয়েছে।
এ সময় তিনি স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ, বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের জন্য ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচি
দিবসটি উপলক্ষে উপাচার্য ভবনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
২১ ফেব্রুয়ারি রোববার সকাল সাড়ে ৬টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে সীমিত পরিসরে একটি প্রভাতফেরি বের করা হবে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান প্রভাতফেরিতে নেতৃত্ব দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, সিন্ডিকেট সদস্য, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এতে অংশ নেবেন। প্রভাতফেরি সহকারে তারা আজিমপুর কবরস্থান হয়ে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে যাবেন এবং পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
নিরাপত্তা প্রস্তুতি
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহিদ দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার এলাকায় কড়া নজরদারি থাকবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘শহিদ মিনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রতি ইঞ্চি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি করা হবে। ডিএমপি কন্ট্রোল রুম থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হবে। এর পাশাপাশি বোমা ডিজপোজাল ইউনিট, সোয়াটসহ অন্যান্য ইউনিটগুলোও সক্রিয় থাকবে।’
বৃহস্পতিবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘দিবসটি ঘিরে সুনির্দিষ্ট হুমকি না থাকলেও জঙ্গি কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি রাখা হবে।’
শহিদ মিনার এলাকায় জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা
তিনি জানান, ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনার কেন্দ্রিক তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। মাস্ক ছাড়া একজনও শহিদ মিনার এলাকায় প্রবেশ করতে পারবেন না। দলগত পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫ জন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে একসঙ্গে দুজনের বেশি প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।
এছাড়া শহিদ মিনার এলাকাকে পাঁচ সেক্টরে ভাগ করে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
রাজধানীর শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে শনিবার দুপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন শেষে তিনি এ কথা বলেন।
র্যাবের মহাপরিচালক বলেন, ‘র্যাবের বোম্ব ডিজপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কয়াড শহিদ মিনার এলাকায় প্রয়োজনীয় তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করবে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সাদা পোশাক ও ইউনিফর্ম টহলের মাধ্যমে র্যাবের সদস্যরা শহিদ মিনার এলাকায় নজরদারি অব্যাহত রেখেছে।’
শহিদ মিনারে যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত
শহিদ মিনার ও আশপাশের এলাকায় ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ২টা পর্যন্ত জনসাধারণের চলাচল ও সব ধরনের চলাচল নিয়ন্ত্রিত করা হবে।
কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ঢোকার সময় সব নাগরিককে পলাশি ক্রসিং, এসএম হল এবং জগন্নাথ হলের সামনের রাস্তা ব্যবহার করতে অনুরোধ করা হয়েছে। কোনোভাবেই অন্য কোনো রাস্তা ব্যবহার করে শহিদ মিনারে ঢোকা যাবে না।
শহিদ মিনার থেকে বের হবার ক্ষেত্রে দোয়েল চত্বরমুখী রাস্তা অথবা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে বের হওয়া যাবে। কোনোভাবে ঢোকার রাস্তা দিয়ে বের হওয়া যাবে না।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী
শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে অনেক ভাষাই এখন বিপন্ন। একটা ভাষার বিলুপ্তি মানে একটা সংস্কৃতির বিলোপ, জাতিসত্তার বিলোপ, সভ্যতার অপমৃত্যু। তাই মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশসহ সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, ‘আমরা যে চেতনায় ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি এবং একই চেতনায় স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সেই চেতনা এবং জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে গত ১২ বছরে আমাদের আর্থ-সামাজিক খাতের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক উন্নয়ন করেছি।’
আগামী মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অচিরেই আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করব।’