বাংলাদেশের সব অর্জন সংগ্রামের মাধ্যমে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকালে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘সংগ্রাম করেই সব অর্জন করতে হয়েছে। কেউ এমনি কিছু করেনি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কিন্তু আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতা অর্জনটাই ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জীবনের প্রত্যেকটা পর্যায়েই আন্দোলন-সংগ্রাম করে অধিকার আদায় করতে হয়েছে। সেধে কেউ কিছু দেয়নি। এটা মনে রাখতে হবে।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করত হলে প্রথমে ভাষা-সংস্কৃতিতে আঘাত করতে হয়। পাকিস্তানিরা সেটাই করেছিল। আমরা জাতির পিতার নেতৃত্বে আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে স্বাধীনতা পেয়েছি।’
এ সময় ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাও তুলে ধরেন সরকারপ্রধান।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘সত্তরের নির্বাচনের পর পুরো পাকিস্তানেই যখন বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল, তখন কিন্তু তারা ক্ষমতা দেয়নি। ১৯৭১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির যে অনুষ্ঠান, সেখানে জাতির পিতা গিয়েছিলেন শহিদ মিনারে ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।
‘সেখানে ফুল দেয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ‘‘১৯৫২ সালের আন্দোলন শুধু ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।” ভাষা আন্দোলন থেকেই কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে তিনি সংগ্রাম করে যান। আর এ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের মাকে মা বলে ডাকার অধিকার পাই, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।’
একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টিও উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে।
তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর কানাডাপ্রবাসী দুজন বাঙালি সালাম এবং রফিক বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি দেশের মাতৃভাষা সংরক্ষণ করার একটি কমিটি করেন।
‘সে সময় জাতিসংঘে তারা আবেদন করেন যেন ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এটা কোনো ব্যক্তি বা ছোট গ্রুপের থেকে এলে হবে না। জাতিসংঘ জানিয়ে দেয় যে সদস্যভুক্ত কোনো দেশের পক্ষ থেকেই এ অনুরোধটা করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখন এটা জানতে পারলাম, সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা এ পদক্ষেপটা নেব। আমাদের পক্ষ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা প্রস্তাব পেশ করলাম। এটা পেশ করার সাথে সাথে ইউনেস্কোর সাথে কাজ শুরু করলাম।
‘১৯৯৯ সালের ৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে স্বীকৃতি দেয়। প্রতিটি দেশ আমাদের সমর্থন দিয়েছিল। এরপর থেকেই সারা বিশ্বে দিনটি পালনে ভূমিকা নেয়া হয়।’
এ বছর জাতীয় ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক পেলেন ২১ বিশিষ্ট নাগরিক। শনিবার সকালে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে পদক তুলে দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হোসেন।
অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত না থাকতে পারায় দুঃখ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে পারলাম না। করোনার জন্য সকলেরই এ বন্দি অবস্থা।’
এ বছর ভাষা আন্দোলনে তিন জন, মুক্তিযুদ্ধ ক্যাটাগরিতে তিন জন, শিল্পকলায় সাত জন, ভাষা ও সাহিত্যে তিন জন এবং সাংবাদিকতা, শিক্ষা, গবেষণা, সমাজসেবা ও অর্থনীতিতে এক জন করে একুশে পদক পেয়েছেন।
একুশে পদক রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা। ভাষা আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে ১৯৭৬ সাল থেকে প্রতি বছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দিয়ে আসছে সরকার।
ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য এবারের একুশে পদক (মরণোত্তর) পান মোতাহার হোসেন তালুকদার (মোতাহার মাস্টার), শামছুল হক ও অ্যাডভোকেট আফসার উদ্দীন আহমেদ।
শিল্পকলায় অবদানের জন্য পদক পান পাপিয়া সারোয়ার (সংগীত), রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সালমা বেগম সুজাতা (অভিনয়), আহমেদ ইকবাল হায়দার (নাটক), সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকি (চলচ্চিত্র), ড. ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় (আবৃত্তি) এবং পাভেল রহমান (আলোকচিত্র)।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এবার একুশে পদক পান গোলাম হাসনায়েন, ফজলুর রহমান খান ফারুক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ ইসাবেলা (মরণোত্তর)।
সাংবাদিকতায় একুশে পদক দেয়া হয়েছে অজয় দাশগুপ্তকে। গবেষণায় অবদানের জন্য পদক পেয়েছেন ড. সমীর কুমার সাহা।
এ ছাড়া শিক্ষায় মাহফুজা খানম, অর্থনীতিতে ড. মির্জা আব্দুল জলিল ও সমাজসেবায় অধ্যাপক কাজী কামরুজ্জামান একুশে পদক পেয়েছেন।
এ বছর ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক দেয়া হয়েছে তিন জনকে। তারা হলেন কবি কাজী রোজী, বুলবুল চৌধুরী ও গোলাম মুরশিদ।