ভাই জি এম কাদেরের উপস্থিতিতে সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সমালোচনা করলেন আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ। হানিফ বলেন, সংবিধান সংশোধন করে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ধারণা এনে দেশে সম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেন সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় বন্দুকের নল দেখিয়ে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করা এরশাদ।
পরে জি এম কাদের বলেন, তার ধারণা তার ভাই সংবিধানে যে সংশেধন এনেছিলেন, তার সঙ্গে সংবিধানের মূল ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার কোনো বিরোধ নেই।
শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক স্মরণসভায় বক্তব্য রাখছিলেন দুই নেতা।
মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত স্মরণে এই আলোচনার আয়োজন করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্ট্রান ঐক্য পরিষদ ওই সভার আয়োজন করে।
সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের হাত থেকে ক্ষমতা নেন এরশাদ।
ছয় বছর পর ১৯৮৮ সালের ৭ জুন সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন এই সেনা শাসক।
সে সময় এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এমনকি জামায়াতে ইসলামীও হরতাল করে। তবে রাষ্ট্রধর্মে হাত দেয়ার সাহস পরে করেনি দুই প্রধান দল।
তবে উচ্চ আদালত এরই মধ্যে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছে।
হানিফ কথা বলেন এরশাদের আগের সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে নিয়েও।
তিনি বলেন, ‘ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান রহমান সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে বিনষ্ট করেছেন। তিনি ধর্মকে টেনে আনলেন এবং তার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করলেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেব অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে এই জিনিসটাকে আরও পাকাপোক্ত করলেন।’
জি এম কাদেরকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘যদিও এখানে জি এম কাদের ভাই আছেন, উনি মনে হয়তো কষ্ট পাবেন। কিন্তু ইতিহাস তো সত্য, ইতিহাসকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এটা আমাদের মানতেই হবে।
‘তারা (জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মী) যদি তাদের ভুল বুঝতে পারেন, স্বীকার করেন, তাহলে ভবিষ্যতে জনগণের জন্য ভালো কাজ করার মানসিকতা তৈরি করতে পারবেন। কিন্তু অতীতের ভুলটাকেই যদি আগলে ধরে রাখতে চান, তবে ভবিষ্যতে আপনাদের দ্বারা জনগণ ভাল কিছু প্রত্যাশা করতে পারে না।’
পরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি এখানে এসব কথা বলতাম না, কিন্তু কিছু কিছু কথা এসেছে, আমাদের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সম্পর্কে। এ সম্পর্কে কিছু কিছু ভুল ধারণা আছে বলে আমি মনে করি। যেহেতু হানিফ সাহেব এ বিষয়ে সরাসরি বলেছেন, আমাদের এ বিষয়টি জানা দরকার।’
তিনি বলেন, “যেটা বলা হয়, যে জাতীয় পার্টির আমলে হুসেনই মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে ৩০ নম্বর আইনের ২ ধারায় বাংলাদেশের সংবিধানের পরিবর্তন উনি নিয়ে এসেছিলেন। সেই ধারাটি হলো ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, কিন্তু অন্যান্য ধর্ম প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে।’ এই বিষয়টিতে আপনাদের সকলের আপত্তি ছিল, অনেকেই এটাকে দ্বিমত প্রকাশ করেছিলেন। পববর্তীতে এটাকে পরিবর্তন করার জন্য আন্দোলনও হয়েছিল।”
২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কথা উল্লেখ করে জি এম কাদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসলো, তখন সংবিধানকে নতুনভাবে সংশোধন করা হয়। কিন্তু সেই পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১৪ নম্বর আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। তবে হিন্দু,বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা নিশ্চিত করিবেন। এটা আওয়ামী লীগ আমলে করা হয়েছে।
‘আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি মনে করি ওই সংশোধনীর সঙ্গে সংবিধানের মূল ভিত্তি ধর্ম নিরপেক্ষতার কোনো বিরোধ নেই।’
এরশাদের ভাই বলেন, ‘আমার যেটা বিশ্বাস এ দেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অসাম্প্রদায়িক। স্বাভাবিকভাবেই তারা ধর্মনিরপেক্ষায় বিশ্বাস করেন। এটা হাজার বছরের আমাদের ঐতিহ্য। কোনো আইন, সংবিধান দ্বারা এটাকে পরিবর্তন আসা সম্ভব নয়।’
শ্রীকৃষ্ণর জন্মদিন, বুদ্ধ পুর্ণিমা ও গুড ফ্রাইডেতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দাবি
আলোচনা সভায় সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদে সাধারণ সম্পাদক রানাদাশ গুপ্ত। তিনি মহানবী (সা.) এর জন্ম ও মৃত্যু দিবস ঈদে মিলাদুন্নবীতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিধান উল্লেখ করে বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালায় সংশোধনী আনার দাবি জানান।
রানাদাশ বলেন, ‘পতাকা বিধিমালায় মহানবীর জন্মদিন পবিত্র ঈদ-এ মিলাদুন্নবীতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে ধর্মপ্রাণ নাগরিক হিসেবে এতে আমরা সবাই আনন্দিত। এ বিধিমালায় সমগ্র জনগোষ্ঠীর বিশাল একাংশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষায়ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এর জন্মদিন শুভ জন্মাষ্টমী, ভগবান বুদ্ধের জন্মদিন শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা এবং মহামতি যীশু খ্রিষ্ট্রের জন্মদিন গুড ফ্রাইডের দিনগুলোতেও জাতীয় পতাকা উত্তোলন সম্বলিত বিধি সংযোজন হলে এসব সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক সমঅধিকার ও সমমর্য়াদা নিশ্চিত করবে।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বিধৃত ধর্মনিরপেক্ষতার মৌলনীতি আক্ষরিক অর্থে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে বাস্তবায়ণ আমাদের সময়ের দাবি।’
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হারুন হাবিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বক্তব্য রাখেন।
স্মরণ সভার শুরুতে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সমরনায়ক সি আর দত্তের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে তার জীবন ও কর্ম পাঠ করে শোনানো হয়।
গত বছরের ২৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় মারা যান সি আর দত্ত। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীর উত্তম খেতাব পাওয়া এই সেনা কর্মকর্তার জন্ম ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে।
তিনি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।