ঢাকার কেরানীগঞ্জে যে বাড়িটি পুকুরে পড়ে গেছে, তাতে রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন বাড়ির মালিকের ১৩ বছরের ছেলে সাদাফ আলম।
তাকে পাওয়া গেল ধসে পড়া বাড়ির পাশের একটি বাড়িতে। ভয় ততক্ষণে কেটে গেছে। বরং বেঁচে যাওয়ার স্বস্তির ছোঁয়াই চোখেমুখে।
বাবা-মা, বোন বা অন্য কেউ ছিল না পাশে। এর মধ্যে ছেলেটি নিউজবাংলাকে বলল কী হয়েছে।
সাদাফ বলে, ‘আমি তো ঘুমে, কিচ্ছু টের পাই নাই। মনে হইলো স্বপ্নের মধ্যে ভূমিকম্প হইল, এরপর দেখি আমি পানির মধ্যে।’
সেখান থেকে কীভাবে উদ্ধার হলো ছেলেটি?
সাদাফ বলে, ‘কতক্ষণ পরে পাশের বাড়ির লোকেরা আমারে বাইর করল। আর কিছু জানি না।’
বাড়িটি জানে আলম নামে একজনের। ঘটনাস্থলে তাকে পাওয়া গেল না। স্থানীয় লোকজন বললেন, তিনি আশপাশেই আছেন। তবে সামনে আসতে চাইছেন না। পরে তাকে পাওয়া যায় মোবাইল ফোনে।
জানে আলমের ক্রোকারিজের ব্যবসা। বাড়ি নিয়ে তথ্য যেটুকু পাওয়া গেছে, তা হলো, অল্প অল্প সঞ্চয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে সেটি।
যে জমির ওপর বাড়িটি দাঁড়িয়ে, সেটি বছরের সাত থেকে আট মাস থাকে পানির নিচে।
ঢাকার কেরানীগঞ্জে ধসে পড়া বাড়ির মালিক জানে আলম (নীল শার্ট পরা)। ছবি: নিউজবাংলা২১ বছর আগে ডোবা থেকে চিকন বিম তুলে একতলা বাড়িটি নির্মাণ করেন জানে আলমের বাবা। এরপর ধীরে ধীরে তিনতলা করা হয়।
এই ব্যবসায়ীর হিসাব অনুযায়ী, ভবনটি ধসে যাওয়ায় তার ৪০ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।
এই জমিকে বহুতল বাড়ি করার ক্ষেত্রে যেসব প্রকৌশলজ্ঞান কাজে লাগানোর দরকার ছিল, তার কোনোটিই নেই জানে আলমের। বা যে কারিগররা বাড়িটি তুলেছেন, তাদেরও যে ধারণা নেই, সেটি এখন দিবালোকের মতোই স্পষ্ট।
ভবনটির দুই ও তৃতীয় তলা ভাড়া দেয়ার পরিকল্পনা ছিল জানে আলমের। তবে তার আগেই সেটি ধসে পড়ায় কয়েকটি পরিবার ঝুঁকিমুক্ত হলো।
জানে আলমের তিন সন্তান, দুই ছেলে-এক মেয়ে। বড় ছেলে আর মেয়ে দুবাই থাকেন।
এখানে তিনি, স্ত্রী, এক ছেলে, মা, গৃহকর্মী ও দুই স্বজন নিয়ে থাকতেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, গুরুতর আহত হননি কেউ। তবে তার মা বেশ ব্যথা পেয়েছেন।
একজন বলেন, ‘একটু কাটছে-ছিঁড়ছে, মাথা ফাটছে।’
তবে জানে আলম ও তার ছেলে সাদাফ ছাড়া বাকিদের মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সকালে এই দুর্ঘটনার পর পর স্থানীয় বাসিন্দারা ছুটে আসেন বাসিন্দাদের উদ্ধার করতে। সে সময় ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলে ছয়টি ইউনিট এসে উদ্ধারকাজ শুরু করে।
যারা উদ্ধারকাজে প্রথমেই ছুটে যান তাদের মধ্যে রিয়াজ ও উজ্জ্বলের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। জানান, সকাল আটটার দিকে ঘর থেকেই বিকট শব্দ শুনতে পান। তখন পুরো এলাকার মানুষ ছুটে আসে। সবাই চিৎকার করছিল। তখন গুজবের ছড়াছড়ি।
রিয়াজ বলেন, ‘আমরা আইসা দেখি জানে আলম সাহেবের বিল্ডিং পানিতে পইড়া গেছে। আর বিল্ডিংয়ের ভেতর থেকে মানুষ চিল্লাইতাছে।
‘সাথে সাথেই আমরা ৮-১০ জন নাইম্মা যাই। আমি উপর দিয়ে একটা জানালার থাই (জানালার ফ্রেম) ভাঙলাম। ভিতরে দেখি কয়ডা রুমে পানি আর সব জিনিস উল্টাইয়া পাল্টাইয়া রইছে।
‘আমি যেই দিক দিয়া ঢুকছি হেইদিক দিয়া জানে আলম আর তার ছোড পোলারে বাইর করছি। এর কতক্ষণ পরেই দেখলাম ফায়ার সার্ভিস আইছে, তারাও আমাগো লগে কাজ করছে।’
উজ্বল বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস খবর পাইয়া আইছে। কিন্তু পাঁচ জনরে উদ্ধার আমরাই করছি। এক বয়স্ক মহিলা আর একটা বাচ্চা মাইয়্যা আটকা পড়ছিল। ফায়ার সার্ভিস গ্রিল কাইট্টা বাইর করছে। আমার নিজেরও পা কাইট্টা গেছে।’
জানে আলম বলেন, ‘১০ বছর ধইরা থাকতেছি, আমার সব ইনকাম দিয়া একটু একটু কইরা এই বাড়ি বানাইছি, আমার সব শেষ। সবাই ঘুমে ছিলাম ক্যামনে কী হইল কিচ্ছু বুঝলাম না।’
ডোবার জায়গায় বাড়ি নির্মাণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্ন রাখলে তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি।
ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ছয়টি ইউনিট সাড়ে আটটা থেকে উদ্ধার কাজ শুরু করে। তিন ঘণ্টা উদ্ধার তৎপরতা শেষে আমরা অভিযান সমাপ্ত করি। ভেতর থেকে আমরা পাঁচ জনকে উদ্ধার করি তাদের কেউই গুরুতর আহত নয়, তবু চিকিৎসার জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’
দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ‘কোনো রকম নিয়মনীতির তেয়াক্কা না করেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে ডোবার ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল ভবনটি। এটি পুরোটাই বেআইনি। আশপাশের আরও এমন একাধিক ভবন রয়েছে।’