‘আমাদের জীবন পিয়ন, চাপরাশির ওপর ছেড়ে দিয়ে আপনারা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নেমে পড়েন’ চিকিৎসকদের উদ্দেশ্য করে এমনটিই বলেছে হাইকোর্ট। আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, ‘আপনারা তো ব্যবসা নিয়ে পড়ে আছেন। হাসপাতালে যান তো শুধু হাজিরা দেয়ার জন্য।'
বৃহস্পতিবার বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এসব মন্তব্য করে।
এ সময় পুলিশকে আদালত বলে, ‘আপনারা দাবি করেন, আপনারা জনগণের বন্ধু। দেশের মানুষ আপনাদের কাছে কী চায়? নিরপরাধ একজন ব্যক্তিকে ধর্ষক বানিয়ে দিতে পারেন আপনারা।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে শিশু ধর্ষণের এক ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশুর তিনটি মেডিকেল রিপোর্ট ও একটি ছাড়পত্রে অসামঞ্জস্যতার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্তে গত বুধবার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।
মেডিকেল রিপোর্টে এমন অসঙ্গতির বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এবং সিভিল সার্জনসহ ১২ জন হাইকোর্টে হাজির হন। এরপর আদালত ধর্ষণের ঘটনায় মেডিকেল রিপোর্টের অসঙ্গতি বিষয়ে পয়েন্ট আকারে তুলে ধরে। এ সময় আদালত চিকিৎসক ও পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন মন্তব্য করে।
চিকিৎসকদের উদ্দেশে আদালত বলে, ‘সাধারণ মানুষের জীবন হাসপাতালের ক্লার্ক, পিয়নের হাতে ছেড়ে দিয়ে আপনারা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নেমে পড়েন। হাসপাতালে আসেন শুধু হাজিরা দেয়ার জন্য। তারপর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এভাবে চলতে পারে না।‘
ভুক্তভোগী শিশুর তিনটি মেডিকেল রিপোর্ট ও একটি ছাড়পত্রে অসঙ্গতি নিয়ে হাইকোর্ট বলে, ‘আপনারা একেক রিপোর্টে একেক তথ্য দিয়েছেন। ভাষাও বোঝা যায় না। সাধারণ মানুষ যেন বুঝতে পারেন এমন ভাষায় রিপোর্ট লিখতে হবে।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসপিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের আদালত বলে, ‘পুলিশকে বলা হয় জনগণের বন্ধু। আমরা আপনাদের কাজকর্মে সেটাই দেখতে চাই।'
পরে তিনটি মেডিকেল রিপোর্ট ও একটি ছাড়পত্রে অসঙ্গতির ঘটনায় দোষ স্বীকার করে নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন একরাম উল্লাহ।
তিনি আদালতকে বলেন, ‘আমাদের ফরমগুলোর মধ্যে ত্রুটি আছে। আমরা এগুলো সংশোধন করে নেব।' এ সময় তিনি ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
পরে আদালত তাদের সতর্ক করে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেয়। তবে আদালত বলে দেয় যে কোনো সময় আদালত ডাকলে হাজির হতে বাধ্য থাকবেন তারা।
আদালতে শিশুটির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. শাহ পরান চৌধুরী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনিরুল ইসলাম। লিগ্যাল এইডের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী কুমার দেবুল দে।
এর আগে সকালে ভুক্তভোগী শিশুর তিনটি মেডিকেল রিপোর্ট ও একটি ছাড়পত্রে অসামঞ্জস্যতার ব্যাখ্যা দিতে হাইকোর্টে হাজির হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন, পুলিশ সুপারসহ ১২ জন।
এরা হলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. একরাম উল্লাহ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিছুর রহমান, নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এটিএম আরিচুল হক, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. একরাম উল্লাহ রেজাসহ অন্যরা।
গত ১৭ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে শিশু ধর্ষণের এই ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশুর তিনটি মেডিকেল রিপোর্ট ও একটি ছাড়পত্রে অসামঞ্জস্যতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন, পুলিশ সুপারসহ ১২ জনকে তলব করে আদালত।
একই সঙ্গে ওই ঘটনায় দুটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেয় আদালত।
এ ছাড়া রুল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় এ ঘটনায় নাসিরনগর থানায় দায়ের করা মামলা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে এবং আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু ও তার পরিবারের সদস্যদের কোনো রকম হয়রানি করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
আদালত এই মামলায় ভুক্তভোগীর (শিশুর) ডাক্তারি পরীক্ষায় কোনো অনিয়ম, অবহেলা বা গাফিলতি হয়েছে কি না তা উদঘাটনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ ছাড়া মামলাটি তদন্তের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম, অবহেলা বা গাফিলতি হয়েছে কি না, তা উদঘাটনের জন্য পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেয়া হয়।
মামলার বিবরণে জানা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে দেওয়া ছাড়পত্রে বলা হয়েছে, ৩ সেপ্টেম্বর শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়। সেখান থেকে দেওয়া আরেক রিপোর্টে বলা হয়, শিশুটির বাহ্যিক কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে সদর হাসপাতালের মেডিক্যাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তাদেরই আরেকটি তথ্য বলছে, জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন হয়েছে।
এজাহার ও নথিপত্র পর্যালোচনা করে আদালত বলেছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর ৬ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভুক্তভোগী শিশুটি নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। চার সদস্যের চিকিৎসকের মেডিকেল বোর্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যৌন নির্যাতন হয়েছে, বিষয়টি প্রশ্নবোধক।
নথিপত্র থেকে জানা যায়, গত ৯ সেপ্টেম্বর বেলা ৩টায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশু (৭) ধর্ষণের শিকার হয়। প্রথমে শিশুটিকে নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশুটির বাবা গত ১১ সেপ্টেম্বর নাসিরনগর থানায় এক শিশুর (১২) বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই মামলায় শিশুটি হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করে। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত নভেম্বর শিশুটিকে আট সপ্তাহের আগাম জামিন দেয়। একই সঙ্গে তদন্তকাজ শেষে এক মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয় আদালত।
এর ধারাবাহিকতায় তদন্ত প্রতিবেদন ও মামলার সিডি (কেস ডকেট) আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। মেডিকেল রিপোর্ট ও তদন্ত রিপোর্টে এমন অসঙ্গতি দেখে আদালত এসব নির্দেশনা দেয়।