দুই দশক আগে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি ও ৪০ কেজি ওজনের দুটি বোমা পুঁতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার আগ মুহূর্তে দোকানি বদিউজ্জামান সরদারের তার খুঁজে পাওয়ার ঘটনাটি প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন সে সময়ের পৌর চেয়ারম্যান ও বর্তমান মেয়র কামাল হোসেন।
এই মামলায় ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হাইকোর্ট বহাল রাখার পর বিষয়টি নিয়ে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় স্থানীয় ওই আওয়ামী লীগ নেতার।
তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর জন্য হেলিপ্যাড ও রাস্তা প্রস্তুতের সময় তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর তাকে তার খুঁজে পাওয়ার কথা জানান দোকানি বদিউজ্জামান। কিন্তু দৈর্ঘ্য দেখে তার মনে সন্দেহ জাগে, এটি সাধারণ কোনো তার নয়।
পরে তিনি যোগাযোগ করেন পুলিশের সঙ্গে। আর পুলিশ জানায় ঊর্ধ্বতন মহলে। ঘটনাস্থলে যায় সেনাবাহিনী।
২০০০ সালে প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা এখনকার মতো সহজ কোনো কাজ ছিল না। মোবাইল ফোন তখন সহজলভ্য নয়, পুলিশের স্থানীয় কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই টুঙ্গিপাড়ায় ব্যস্ত।
২০০০ সালের ২১ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জনসভা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। আগে থেকে চলছিল নানা প্রস্তুতি। আগের দিন জনসভাস্থলের পাশের পুকুরে পানি আনতে গিয়ে লম্বা তার দেখতে পান চায়ের দোকানি বদিউজ্জামান সরদার।
- আরও পড়ুন: মৃত্যুদণ্ড গুলি নাকি ফাঁসির দড়িতে?
পৌর চেয়ারম্যান কামাল ঘটনাস্থলে ছিলেন হেলিপ্যাড ও রাস্তা তৈরির কাজ করতে। বদিউজ্জামানের দোকানে যাওয়ার পর তাকে দেখানো হয় তারটি।
এর পরের কাহিনি নিউজবাংলাকে জানান কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সেদিন আমাদের দায়িত্ব ছিল কোটালীপাড়া পৌরসভা থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে স্টেজে বসে বক্তব্য রাখবেন সেটা সংস্কার এবং স্টেজে যাওয়ার রাস্তাটাকে কমপ্লিট করা।
‘দু-তিন দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছিলাম না। পৌরসভায় কর্মরত তখন যে উপ-সহকারী প্রকৌশলী ছিলেন, তাকে আমি বলেছিলাম, তুমি ২৪ ঘণ্টার জন্য লেবার রাখবা। বৃষ্টি এক ঘণ্টার জন্য থামুক কিংবা আধা ঘণ্টার জন্য থামুক ওই সময়ে যেন কাজ এগিয়ে রাখা যায়।’
কিন্তু টানা বৃষ্টির মধ্যে কাজ কতটা এগিয়েছে সেটা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, ‘তাই পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি ওই স্পটে যাই- রাস্তা এবং স্টেজটা দেখার জন্য।
“আমি যাওয়ার পর বদিউজ্জামান সরকার- এক জন চা বিক্রেতা, সে বলল, ‘যে ভাই, একটা তার দেখা গেছে।’
‘আমি তারে বললাম, কইরে ভাই? কী তার দেখা গেছে?
- আরও পড়ুন: যার জন্য সেদিন প্রাণে বাঁচেন শেখ হাসিনা
‘তো সে হাত দিয়ে পানির থেকে জাগাল। এই তারটা কিন্তু দক্ষিণ পাশ থেকে জাগল, পানির ভেতরের তার। ১৫-২০ হাতের মত জাগল।
“আমি বললাম, উত্তর দিকেও কি তারটা আছে? সে বলল, ‘হ্যাঁ, ভাই উত্তর দিকেও আছে।’
“বললাম, জাগাও তো দেখি। সে জাগালো। তিন চার হাত জাগলো, তারপর আর জাগলো না।”
এরপর কামালের মনে সন্দেহ ঢুকল। তার মাথায় তখন খেলছিল মাইকের তার কিংবা ইলেকট্রিকের তার পানির ভেতরে থাকার কথা নয়।
‘আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করব। কিন্তু টুঙ্গিপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানকে ঘিরে ওই সময় কোটালীপাড়া থানায় দু চারজনের বেশি কেউ ছিলেন না।’
কামাল হোসেন বলেন, ‘এক জন এসআই, চার-পাঁচ জন কনস্টেবল ছাড়া আর সবাই ছিলেন টুঙ্গিপাড়াতে। তিন দিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল।’
‘পরে আমি ওখান থেকে আমাদের পার্টি অফিসে থাকা মান্ধাতার আমলের হাত দিয়ে ঘুরানো টেলিফোন থেকে থানার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না।’
কামাল হোসেন বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর এক্সচেঞ্জ হয়ে আমি থানার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম। ডিউটিতে থাকা কনস্টেবলের সঙ্গে কথা বলে দায়িত্বরত এক জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলি। ওই কর্মকর্তার নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
‘তাকে আমি জানালাম আমি তো একটা তার দেখেছি। সেটা নিয়ে আপনাদের একটু ধারণা নেয়া দরকার।’
থানায় যোগাযোগ করে বাসায় গেলেন কামাল হোসেন। বাসা থেকে ফিরে আবার পার্টি অফিসে আসলেন তিনি। সেখানে বসেই লক্ষ্য করলেন, গাড়িবহর যাচ্ছে। উৎসুক মানুষ তাকিয়ে দেখছিল, কামালও দেখছিলেন। ২৫-৩০টা গাড়ি একসঙ্গে গেল।
কামাল বললেন, ‘এর কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম বোমা পাওয়া গেছে।’
‘থানায় আমি জানানোর পর তারা সেই ইনফরমেশনটা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা কর্মীদেরকে জানান। তারপর তারা গিয়ে বোমা উদ্ধার করেন।’
রায়ের প্রতিক্রিয়া
ওই ঘটনায় মামলায় ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট রায় হয়েছিল বিচারিক আদালতে। ১০ জনের ফাঁসির পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকজনকে দেয়া হয় নানা মেয়াদের সাজা।
সাড়ে তিন বছর পর বুধবার হাইকোর্ট ডেথ রেফারেন্স শুনানি নিয়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে ১০ জনেরই।
এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মেয়র কামাল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি আজকে খুব খুশি হয়েছি।… নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালত বহাল রেখেছে, তাতে শুধু আমি নই, এই এলাকার অনেক মানুষ খুশি হয়েছে। এই ধরনের সন্ত্রাসীরা একটা গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করবে এটা আমাদের জন্য সত্যি দুঃখজনক। আমরা চাইব সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আমার নেত্রী বেঁচে থাকুক। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক।